পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

) e\ు বিভূতি-রচনাবলী পাড়াগায়ের বেষ্টিমের আখড়ায় একখানা পাথর দেখেছিলাম—তার ওপরে পায়ের চিহ্ন খোদাই করা, আখড়ার অধিকারী পয়সার লোভে যাত্রীদের বলতে ওটা খোদ শ্রীকৃষ্ণের পায়ের দাগ, সে বৃন্দাবন থেকে সংগ্রহ ক'রে এনেছে পাথরখানা। আমি দেখেছি একটি তরুণী ভক্তিমতী পল্লীবধূকে চোখের জলে আকুল হয়ে পাথরটা গঙ্গাজলে ঘুরে নিজের মাথার লম্বাচুল দিয়ে মুছিয়ে দিতে। কি জানি কোথায় পৌছল ওর প্রণাম । কোন উৰ্দ্ধমূল অধোশাখ দেবতা ওর সেবা গ্রহণ করতে সেদিন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন র্তার বহুপল্লবিত বাহু ? কি অপূৰ্ব্ব স্বৰ্য্যাস্ত হচ্ছে বিশাল পশ্চিম দিগন্তে ! দূরের তালগাছের মাথাগুলো যেন বাঁধাকপির মত ছোট দেখাচ্ছে, গুড়িগুলো দেখাচ্ছে যেন সরু সরু নলখাগড়ার ডাটা—আর তার ওপরকার নীলাকাশে রঙীন মেঘলোকে পিঙ্গলবর্ণের পাহাড়, সমুদ্র, কোন স্বল্পসাগরের অজানা বেলাভূমি “পায়ের নীচের মাটি সারাদিন রোদে পুড়েছে-বাতাসে তারই মুগন্ধ। মালতী বললে—বিষ্ণুমন্দিরে সাজ জলে নি এখনও । প্রদীপ দিইগে চলুন— সেখানে ওর বাবার মন্দিরে প্রদীপ দেওয়া হয়ে গেল। আমি পুকুরপাড়ের তেঁতুলগাছের মোটা শেকড়ে বসলুম, ও দাড়িয়ে রইল। বললাম—আমার তুমি যে খৃষ্টান বল, তুমি আমার কথা কিছু জান না। তার পর ওকে আমার বাল্যজীবন, মিসনারী মেমদের কথা, আমাদের দারিদ্র্য, মা, সীতা ও দাদার কথা সব বললাম। বিশেষ ক'রে উল্লেখ করলাম আমার সেই দৃষ্টিশক্তির কথাটা—যা এখন হারিয়েছি। ছেলেবেলার ঘটনা আমার এখন আর তেমন মনে নেই—তবুও বললাম যা মনে ছিল—যেমন চা-বাগানের দু-একটা ঘটনা, বালো পানীর মৃত্যুদিনের ব্যাপার, হীরু রায়ের মৃত্যুর কথা, মেজবাবুর পুত্রসস্তান হওয়া সংক্রান্ত ব্যাপার। বললাম—যীশুখৃষ্টকে ভক্তি করি বলে অনেক লাঞ্ছনা সহ করেছি জীবনে । কিন্তু সে আমার দোষ নয়, ছেলেবেলার শিক্ষণ । ওই আবহাওয়াতে মানুষ হয়েছিলাম। আমি এখনও তার ভক্ত। তুমি তার কথা কিছু জান না—বুদ্ধ চৈতন্য যেমনি মহাপুরুষ, তিনিও তেমনি । মহাপুরুষদের কি জাত আছে মালতী কর আদায় করতো লেভি, ইহুদীসমাজে সে ছিল নীচ, পতিত, সমাজের ঘৃণ্য । সবাই তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে চলে যেত। যীশু তাকে বললেন—লেভি, তুমি নীচ কে বলে ? তুমি ভগবানের সন্তান। লেভি আনন্দে কেঁদে ফেললে । সমাজের যত হেয় লোককে তিনি কোল দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বেশু্যা ছিল, জালজীবী ছিল, কুষ্ঠা ছিল । তাকে সবাই বলতে পাগল, ধৰ্ম্মহীন, আচারভ্রষ্ট। তার বাপ, মা, ভাই আপনার জনও তাকে বলতে পাগল—তারা জানতো না ঈশ্বরকে যে জেনেছে, তার বাইরের আচারের প্রয়োজন নেই। র্তার ধৰ্ম্ম সেবার ধৰ্ম্ম । তার পর আমি ওকে সেদিনকার অভিজ্ঞতার কথা বললাম। পুকুরের ওপারে দুরবিসর্পিত আকাশের দিকে চোখ রেখে আমার মনে এল যে রাঢ়দেশের এই সীমাহীন রাঙামাটির মাঠের মধ্যে সেদিন আমি অন্ত এক দেবতার স্বপ্ন দেখেছি। সে কি বিরাট রূপ। ওই রাঙা গোধূলির মেঘে, বর্ণে, আকাশে তার ছবি । তার আসন সর্বত্র—তালের সারিতে, তমাল-নিকুঞ্জে, পুকুরে ফোটা মৃণালদলে, দুঃখে শোকে, মানুষের মুখের লাবণ্যে, শিশুর হাসিতে “সে এক অদ্ভূত দেবতা। কিন্তু কতটুকুই বা সে অনুভূতি হ’ল । যেমন আসা অমনি মিলিয়ে যাওয়া . মালতী, আগেই বলেছি, অদ্ভুত শ্রোতা। সে কি একান্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনলে যখন আমি বকে গেলুম ! চুপ করে রইল অনেকক্ষণ, যেন কি ভাবছে। তারপর হঠাৎ বললে—আচ্ছ, আপনাকে একটা কথা বলি। প্রেম ও সেবার ধর্শ্ব কি শুধু ধীশুখ্রষ্টের দেওয়া ? আমাদের দেশে ওসব বুঝি বলে নি ? আমাদের আখড়ায় লোচনদাস