পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ১২৫ আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম—ও কি কথা দাদা! তুমি সেরে ওঠ, তোমায় বাড়ি নিয়ে যাব, তোমার সংসার তুমি দেখবে। o দাদা চুপ ক’রে রইল । বিকেলে দাদার ওয়ার্ডে ঢুকবার আগে মনে হ’ল দাদা তো বিছানাতে বসে নেই। গিয়ে দেখি দাদা আগাগোড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মাথার কাছে চার্টে দেখি জর উঠেছে ১০৪ ডিগ্রীর ঘরে। পাশের বিছানার রোগী বললে—আপনি চলে যাবার পরে খুব জর এসেছে। কোন কথা বলতে পারেন নি, আপনি আসবার আগে ডেকেছিলাম, সাড়া পাই নি । সেদিন সারাদিন তেমনি ভাবে কেটে গেল। পরদিনও তাই, দাদার জ্ঞান আর ফিরে এল না—জরও কমল না, পরদিন রাত্রে আমি রোগীর কাছে রইলাম । ও, কি বর্ষ সে রাত্রে । ঘনকৃষ্ণ শ্রাবণের মেঘপুঞ্জে আকাশ ছেয়ে গিয়েছে, নির্নিরীক্ষ্য অন্ধকারে কোথাও একটা তারা চোখে পড়ে না । একথানা বই পড়ছিলাম দাদার বিছানার ধারে বসে। রাত বারোটায় একবার নার্স এল । আমি তাকে বললাম—রোগীর অবস্থা খারাপ —একবার রেসিডেণ্ট মেডিকেল অফিসারকে ডাকাও । ডাক্তার এল, চলেও গেল। রাত তখন দেড়টা। বাইরে কি ভীষণ মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ ভেঙে পড়বে বুঝি পৃথিবীর ওপরে —স্বষ্টি বুঝি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। একজন ছাত্র এসে রোগী দেখে বললে—ইনজেকৃশন দিতে হবে। আমি বললাম—বেশ দিন— তারপর আমি বাইরে এসে দাড়ালুম। ঘন মেঘে মেঘে আকাশ অন্ধকার । হাসপাতালের বারান্দাতে কুলিরা ঘুমুচ্ছে। টটেনাস্ ওয়ার্ড থেকে অনেকক্ষণ ধরে আর্ত পশুর মত চীৎকার শোনা যাচ্ছে—একবার সেটা থামছে, আবার জোরে জোরে হচ্ছে । সামনের ওয়ার্ডে মেম নার্সটা ঘুরে বেড়াচ্ছে বারান্দাতে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হেড, লাইট জালিয়ে একখানা মোটর এসে ওয়ার্ডের সামনে দাড়াল । সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট তদারক করতে এসেছেন। দাদাকে তিনি দেখলেন। নার্সকে কি বললেন। ছাত্রটিকে ডেকে কি জিজ্ঞেস করলেন। ছাত্রটি আর একটা ইনজেকশন দিলে । রাত আড়াইটে। বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। হাসপাতালের বারান্দার ওদিকের আলোগুলো নিবিয়ে দিয়েছে —অনেকটা অন্ধকার । - দাদার সঙ্গে অনেক কথা বলবার ইচ্ছে হচ্ছিল । ছেলেবেলাকার কথা, দাৰ্জিলিঙের কথা । সেই আমরা কার্ট রোড ধ'রে উস্প্লাঙের মিশন-হাউস্ পর্য্যন্ত বেড়াতে যেভূম, মনে আছে দাদা ? একদিন থাপা তোমাকে কাদার পুতুল গড়িয়ে দিয়েছিল। মুরগীর ঘরে লুকিয়ে তুমি আর আমি মিছরি চুরি করে শরবৎ খেতুম ? তুমি দোকান করলে আটঘরাতে বাবা মারা যাওয়ার পরে পাচ সের মুন, আড়াই সের আটা, পাচ পোয়া চিনি নিয়ে—সবাই ধার নিয়ে দোকান উঠিয়ে দিলে। বৌদিদিকে কি বলব দাদা ? এবার এসে দাদার খাটের পাশে বসে রইলাম। একটানা বৃষ্টি-পতনের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে কেবল টিটেনাস ওয়ার্ড থেকে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়েও সেই আৰ্ত্ত চীৎকারটা শোনা যাচ্ছে। একটা ছোট ছেলের টনসিল কাটা হয়েছিল—সে একবার ঘুম ভেঙে উঠে খাবার চাইলে। কুলিটা উঠে তাকে জল দিলে। এই কুলিগুলো ওই বুড়ে মেথরট, মার্সের-এর ঘুমের কখন ? লারারাত জেগে জেগে