পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RNు বিভূতি-রচনাবলী রোগীদের ফাইফরমাশ খাটছে। দাদার অবস্থা খারাপ বলে সবাই এসে একবার করে দেখে যাচ্ছে । নার্স যে কতবার এল! সবাই তটস্থ দাদাকে বাচাবার জন্তে সবারই যেন প্রাণপণ চেষ্টা। বাঁচলে সবাই খুশী হয়। নার্স একবার আমার বললে—তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও বাৰু। সারারাত জেগে বসে থাকলে আমুখ করবে তোমার । হাতপাতালটিকে আমার মনে হ’ল যেন স্বর্গ। আর্তের সেবা যেখানকার মামুষে মনপ্রাণ দিয়ে করে, সে স্বৰ্গই। ওই বুড়ে মেথরটা এখানকার দেবদূত। যেদিন কয়েক শতাব্দী আগে শ্ৰীচৈতন্য গৃহত্যাগ করেছিলেন, কিংবা শঙ্করাচাৰ্য্য সংসারের অসারত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলেনর্তাদের স্বপ্নে এই স্বর্গের কল্পনা ছিল । চৈতন্যদেবের সংকীৰ্ত্তনের দলে নবদ্বীপের গঙ্গার তীরে এই বুড়ে মেথরটা যোগদান করতে পারত, তিনি ওকে কোল দিতেন, ঝাড়খণ্ডের পথে শ্ৰীক্ষেত্র রওনা হবার সময়ে ওকে পাশ্বচর ক’রে নিতেন । •••রাত সাড়ে তিনটে । রাত আজ কি পোয়াবে না ? বৃষ্টি একটু থেমেছে। আকাশ কিন্তু মেঘে মেঘে কালে । এই সময়ে দাদার নাভিশ্বাস উপস্থিত হ’ল। কলের ঘোলা জল দাদার মুখে দিলাম। কানের কাছে গঙ্গানারায়ণব্ৰহ্ম নাম উচ্চারণ করলাম। এই বিপদের সময় কি জানি কেন মালতীর কথা মনে পড়ল। মালতী যদি এখানে থাকত। আটঘরার অশ্বখতলার সেই বিষ্ণুমূৰ্ত্তির কথা মনে পড়ল—হে দেব, দাদার যাওয়ার পথ আপনি সুগম ক’রে দিন। আপনার আশীৰ্ব্বাদে তার জীবনের সকল ক্ৰটি, সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে পবিত্র হোক, যে সমুদ্র আপনার অনন্ত শয্য, যে লোকালোক পৰ্ব্বত আপনার মেখলা—সে-সব পার হয়েও বহুদূরের যে পথে দাদার আজ যাত্র, আপনার কৃপায় সে পথ তার বাধাশূন্ত হোক, নির্ভয় হোক, মঙ্গলময় হোক। পাশের বিছানার রোগী বললে—একবার মেডিকেল অফিসারকে ডাকান না ! আমি বললাম—আর মিথ্যে কেন ? তার পর আরও ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। আমার ঘুম এসেছে, ভয়ানক ঘুম। কিছুতেই আর চোখ খুলে রাখতে পারি নে। মধ্যে নার্স দুবার এল, আমি তা ঘুমের ঘোরেই জানি— আমায় জাগালে না। পা টিপে টিপে এল, পা টিপেই চলে গেল । হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভোর হবার দেরি নেই, হাসপাতালের আলো নিম্প্রভ হয়ে এসেছে—কিন্তু ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢাকা, দিনের আলো যদিও একটু থাকে, বোঝা যাচ্ছে না। দাদার খাটের দিকে চেয়ে আমি বিস্ময়ে কেমন হয়ে গেলাম। এখনও ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি নাকি ? দাদার থাটের চারি পাশে অনেক লোক দাড়িয়ে । অৰ্দ্ধচন্দ্রাকারে ওরা দাদার খাটটাকে ঘিরে দাড়িয়েছে। শিয়রের কাছে মা, ডানদিকে বাবা, বাবার পাশেই আটঘরার সেই হীরু রায়—স্তালাইনের টিনটা যেখানে ঝোলানো, সেখানে দাড়িয়ে আমাদের চা-বাগানের নেপালী চাকর থাপা, ছেলেবেলায় দাদাকে যে কোলেপিঠে ক’রে মানুষ করেছিল। তার পরই আমার চোখ পড়ল খাটের বা দিকে, সেখানে দাড়িয়ে আছে ছোট কাকীমার মেয়ে পানী। এদের মূৰ্ত্তি এত মুস্পষ্ট ও বাস্তব যে একবার আমার মনে হ’ল ওদের সকলেই দেখছে বোধ হয়। পাশের থাটের রোগীর দিকে চেয়ে দেখলুম, সে যদিও জেগে আছে এবং মাঝে মাঝে দাদার খাটের দিকে চাইছে—কিন্তু তার মুখ-চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল মুমূর্ধ্ব দাদাকে ছাড়া সে আর কিছু দেখছে না। অথচ কেন দেখতে পাচ্ছে না, এত স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ, সজীব মানুষগুলোকে কেন যে ওরা দেখে না—এ ভেবে ছেলেবেলা থেকে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। আমি জানি এসব কথা লোককে বিশ্বাস করানো শক্ত। মায়ুৰ চোখে যা দেখে না,