পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ՏՀԳ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যা পারে না—তা বিশ্বাস করতে সহজে রাজী হয় না । এই জন্তে হাসপাতালের এই রাত্রিটির কথা আমি একটি প্রাণীকেও বলি নি কোনদিন । 翰 দু-তিন মিনিট কেটে গেল। ওরা এখনও রয়েছে । আমি চোখ মুছলাম, এদিক-ওদিক চাইলাম—চোখে জল দিলাম উঠে । এখনও ওরা রয়েছে। ওদের সবারই চোখ দাদার খাটের দিকে। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে পানীর কাছে দাড়ালাম। ওরা সবাই হাসিমুখে আমার দিকে চাইলে । কত কথা বলব ভাবলাম মাকে, বাবাকে, পানীকে—থাপা কবে মারা গিয়েছে জানি নে—সে এখনও তাহলে আমাদের ভোলে নি ? তাকে কি বলব ভাবলাম-কিন্তু মুখ দিয়ে আমার কথা বেরুল না। এই সময়ে নাস এল । আমি আশ্চৰ্য্য হয়ে ভাবছি নাস কি এদের দেখতে পাবে না ? এই তো সবাই এরা এখানে দাড়িয়ে । নাস কিন্তু এমন ভাবে এল যেন আমি ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। দাদার মুখের দিকে চেয়ে বললে—এ তে হয়ে গিয়েচে—এ কুলি, কুলি— কুলি খাটটাকে ঘেরাটোপ দিয়ে ঢেকে দিতে এল । তথনও ওরা রয়েছে । • • • তার পর আমার একটা অবসন্ন ভাব হ’ল—আমার সেই সুপরিচিত অবসন্ন ভাবটা । যখনই এ-রকম আগে দেখতাম, তখনই এরকম হ’ত । মনে পড়ল কত দিন পরে আবার দেখলাম আজ—বহুকাল পরে এই জিনিসটা পেয়েছি—হারিয়ে গিয়েছিল, সন্ধান পাই নি অনেক দিন, ভেবেছিলুম আর বোধ হয় পাব না—আজ দাদার শেষশয্যার পাশে দাড়িয়ে তা ফিরে পেয়েছি। আমার গা যেন ঘুরে উঠল—পাশের চেয়ারে ধপ, ক'রে বসে পড়লাম। নাস আমার দিকে চেয়ে বললে—পুওর বয় | জীবনে নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন কাজ একেবারে করি নি তা নয়, কিন্তু বৌদিদিকে দাদার মৃত্যুসংবাদটা দেওয়ার মত নিষ্ঠুর কাজ আর যে কখনও করি নি, একথা শপথ করে বলতে পারি। বেলা দুটোর সময় দাদার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। পথে দাদার শ্বশুরবাড়ির এক সরিকের সঙ্গে দেখা। আমার মুখে খবর শুনেই সে গিয়ে নিজের বাড়িতে অবিলম্বে খবরটি জানালে । বোধ হয় যেন বৌদিদির ওপর আড়ি করেই ওদের বাড়ির মেয়ের'—যারা দাদার অমুখের সময় কখনও চোখের দেখাও দেপতে আসে নি—চীৎকার করে কান্না জুড়ে দিলে। বৌদিদি তখন অত বেলায় দুটাে রোধে ছেলেমেয়েকে খাইয়ে আঁচিয়ে দিচ্ছে। নিজে তখনও থায় নি। পাশের বাড়িতে কান্নার রোল শুনে বৌদিদি বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করছে—হ্যা রে বিহু, ওরা কাদছে কেন রে ? কি খবর এল ওদের ? কারও কি অমুখ-বিমুখ ? এমন সময়ে আমি বাড়ি ঢুকলাম। আমার দেখে বৌদিদির মুখ শুকিয়ে গেল। বললে —ঠাকুরপো ! তোমার দাদা কোথায় ? আমি বললাম—দাদা নেই, কাল মারা গিয়েছে। বৌদিদি কাদলে না। কাঠ হয়ে দাড়িয়ে রইল আমার মুখের দিকে চেয়ে । পাশের বাড়িতে তখন ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা ছন্দে ও স্বরে শোক-প্রকাশের ঘটা কি ! পাড়ার অনেক মেয়ে এলেন সাক্ষন দিতে বৌদিদিকে। কিন্তু একটু পরে যখন বৌদিদি পুকুরের ঘাটে নাইতে গেল, সঙ্গে একজন যাওয়া দরকার নিয়মমত—তখন—এক একটা অজুহাতে যে যার বাড়িতে চলে গেল। আমি বিস্থিত হলাম এই ভেবে যে এরা তো বৌদিদির বাপের বাড়িরই লোক। তার একটু পরে বৌদিদি খানিকটা কালে। হঠাৎ কানা থামিয়ে