পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২৮ বিভূতি-রচনাবলী বললে শেষকালে জ্ঞান ছিল ঠাকুরপো । সেই তো মরেই গেল-হাসপাতালে না নিয়ে গেলেই হ’ত! তবু আপনার জন কাছে থাকত । আমি বললাম—বৌদিদি, তুমি ভেবো না, এখানে যে রকম গতিক দেখছি তাতে এখানে থাকলে দাদার চিকিৎসাই হ’ত না । এখানে কেউ তোমায় তো দেখে না দেখছি । হাসপাতালের লোকে যথেষ্ট করেছে। বাড়িতে সে রকম হয় না। আমাদের অবস্থার লোকের পক্ষে হাসপাতালই ভাল । - বৌদিদির বাবা মা কেউ নেই—ম আগেই মারা গিয়েছিলেন—বাবা মারা গিয়েছেন আর বছর। এ কথা কলকাতাতেই বৌদিদির ভায়ের মুখে শুনেছিলাম। বৌদিদির সে ভাইটিকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এ নিতান্ত অপদার্থ—তার ওপর নিতান্ত গরীব, বর্তমানে কপৰ্দকহীন বেকার—তার কিছু করবার ক্ষমতা নেই। বয়সও অল্প, সে কলকাতা ছেড়ে আসে নি, সেখানে চাকুরির চেষ্টা করছে। ভেবে দেখলাম এদের সংসারের ভার এখন আমিই না নিলে এতগুলি প্রাণী না থেয়ে মরবে। দাদা এদের একেবারে পথে বসিয়ে রেখে গেছে। কাল কি করে চলবে সে সংস্থানও নেই এদের । তার উপর দাদার অমুখের সময় কিছু দেনাও হয়েছে। এদের ছেড়ে কোথাও নড়তে পারলুম না শেষ পৰ্য্যস্ত। কালীগঞ্জেই থাকতে হ’ল। এখান থেকে দাদার সংসার অন্ত স্থানে নিয়ে গেলাম না, কারণ আটঘরাতে এদের নিয়ে যাবার যো নেই, অন্ত জায়গায় আমার নিজের রোজগারের সুবিধা না হওয়া পৰ্য্যন্ত বাড়ি-ভাড়া দিই কি ক’রে ? এ সময়ে সাহায্য সত্যি সত্যিই পেলুম দাদার সেই মাসীমার কাছ থেকে—সেই যে বাতাসার কারখানার মালিক কুণ্ডু মশায়ের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী—সেবার যিনি আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন । এই বিপদের সময় আমাদের কোন ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর কাছ থেকে সে-রকম সাহায্য আসে নি । ক্রমে মাসের পর মাস যেতে লাগল। সংসার কখনো করি নি, করবো না ভেবেছিলাম । কিন্তু যখন এ-ভাবে দাদার ভার আমার ওপর পড়ল, তখন দেখলাম এ এক শিক্ষা–মামুষের দৈনন্দিন অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে, ছোটখাটো ত্যাগ স্বীকারের মধ্যে দিয়ে, পরের জন্যে খাটুনি ও ভাবনার মধ্যে দিয়ে, তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর পারিপার্শ্বিকের মধ্যে দিয়ে এই যে এতগুলি প্রাণীর মুথ-স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবন-যাত্রার গুরুভার নিজের ওপর নিয়ে সংসার-পথে চলার দুঃখ—এই দুঃখের একটা সার্থকতা আছে। আমার জীবন এর আগে চলেছিল শুধু নিজেকে কেন্দ্র করে, পরকে মুখী ক'রে নিজেকে পরিপূর্ণ করার শিক্ষা আমায় দিয়েছে মালতী। পথে বেরিয়ে অনেক শিক্ষার মধ্যে এটিই আমার জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষণ । - কত জায়গায় চাকুরি খুঁজলাম। আমি যে লেখাপড়া জানি বাজারে তার দাম কানাকড়িও না। হাতের কোন কাজও জানি নে, সবতাতেই আনাড়ি। কুণ্ডু মহাশয়ের স্ত্রীর সুপারিশ ধরে বাতাসার কারখানাতেই খাতা লেখার কাজ যোগাড় করলাম—এ কাজটা জানতাম, কলকাতায় চাকুরির সময় মেজবাবুদের জমিদারী সেরেস্তায় শিখেছিলাম তাই রক্ষে । কিন্তু তাতে ক'টাক আসে ? বৌদিদির মত গৃহিণী, তাই ওই সামান্ত টাকার মধ্যে সংসার চালানো সম্ভব হয়েছে । - -