পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী טאס צ' এসে ওকে খাওয়ালুম। গোয়ালাকে কত খোশামোদ করেও বেলা বারোটার আগে কিছুতেই দুধ দেওয়ানো গেল না। মানুষ যদি বিবেচনাহীন হয়, নিৰ্ব্বোধ হয়, তবে বাইরে থেকে তাকে পশুর চেয়েও নিষ্ঠুর মনে করা দোষের নয়। যখন খুকীর দুধের জন্তে আমি সারা গ্রামখানার প্রত্যেক গোয়ালাবাড়ি খুজে বেড়িয়েছি, যদি সকালের দিকে কেউ একটু দুধ দিতে পারে—যে বলেছে হয়ত ওখানে গেলে পাওয়া যাবে সেখানেই ছুটে গিয়েছি, আগাম টাকা দিতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিবারই বিকল হয়ে ফিরে এসেছি—সে সময় ঠিক আমার বাড়ির পাশেই সুরপতি মুখুয্যের বাড়িতে দেড় সের করে দুধ হ’ত । সুরপতি সস্ত্রীক বিদেশে থাকেন, বাড়িতে থাকেন তার বিধবা ভাজ নিজের একমাত্র বিধবা মেয়ে নিয়ে । এদের অবস্থা ভাল, দোতলা কোঠা বাড়ি, ছ-সাতটা গরু, জমিজমা, ধানভরা গোলা । সকালে মায়ে-ঝিয়ের চা খাবার জন্যে দুধ দোয়া হ’ত, মেয়েট নিজেই গাই দুইতে জানে, সকালে আধ সের দুধ হয়, দুপুরে বাকী এক সের। ওঁরা জানেন যে দুধের জন্তে খুকীর কি কষ্ট যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমার এ সম্বন্ধে কথাও হয়েছে অনেকবার। আমায় অনেকবার প্রৌঢ়া মহিলাটি জিজ্ঞেসও করেছেন আমি দুধের কোন সুবিধে করতে পারলাম কি না—দু-চার দিন সকালে ডেকে আমায় চা-ও থাইয়েছেন, কিন্তু কখনও বলেন নি, এই ভূধৰ্টুকু নিয়ে গিয়ে খুকীকে খাওয়াও ততক্ষণ। আমিও কখনও তাদের বলি নি এ নিয়ে, প্রথমতঃ আমার বাধ-বাধ ঠেকেছে, দ্বিতীয়ত: আমার মনে হয়েছে, এরা সব জেনেও যখন নিজে থেকে দুধের কথা বলেন নি, তখন আমি বললেও এরা ছলছুতো তুলে দুধ দেবেন না। তবুও আমি এদের নিষ্ঠুর বা স্বার্থপর ভাবতে পারি নে—বিবেচনাহীনতা ও কল্পনাশক্তির অভাব এদের এরকম করে তুলেছে। কতবার ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছি—“ওর কষ্ট আমি আর দেখতে পারি নে, আপনি ওকে একটু দুধ দিন।" ওর মুখের সে অবোধ উল্লাসের হাসি প্রতিবার ছুরির মত আমার বুকে বিধেছে। কতবার মনে মনে ভেবেছি আমি যদি দেশের-ডিকুটেটর হতাম, তবে আইন ক’রে দিতাম শিশুদের দুধ না দিয়ে কেউ আর কোন কাজে দুধকে লাগাতে পারবে না । কতবার ভেবেছি বৌদিদি যদি না বাচে, এই কচি শিশুকে আমি কি ক’রে মানুষ করব ? স্তন্যদুগ্ধ একে কেউ দেবে না এই পাড়াগায়ে, বিলিরে দিলেও মেয়েসন্তান কেউ নিতে চাইবে না —নিতান্ত নীচু জাত ছাড়া । আটঘরাতে থাকতে ছেলেবেলায় এরকম একটা ব্যাপার শুনেছিলুম —গ্রামের শশীপদ ভট্চাজের কেউ ছিল না—এদিকে শিশু দুটিই মেয়ে, অবশেষে যত্ন মুচির বে। এসে মেয়ে দুটিকে নিয়ে গিয়েছিল ; এই সোনার খুকীকে সেই রকম বিলিয়ে দিতে হবে পরের হাতে ? কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে চেয়ে এই ভাবনায়। এই বিপদে আমার প্রায়ই মনে হয়েছে মালতীর কথা । মালতী আমায় এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবে, সে কোন উপায় বার করবেই, যদি খুকীকে বুকে নিয়ে তার কাছে গিয়ে দাড়াই। সে চুপ করে থাকতে পারবে না। ভার ওপর অভিমান ক’রে চলে এসেছিলাম, দেখা পৰ্য্যন্ত ক’রে আসি নি আসার সময়—আর তার পর এতদিন কোন খোঁজখবর নিই নি—একখানা চিঠি পৰ্য্যন্ত দিই নি, আমার বিপদের সময় সে আমার সব দোধ ক্ষমা ক’রে নেবে } কিন্তু খুকী আমার সব চিন্তা থেকে মুক্ত করে দিলে। তার যে হাসি কেউ দেখতে চাইত না, একদিন শেষরাত্রি থেকে সে হাসি চিরকালের জন্ত মিলিয়ে গেল। অল্পদিনের জন্তে এসেছিল