পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 বিভূতি-রচনাবলী কালেই, চারিধারে বড় বড় আম আর স্বপুরির বাগান। এতটুকু রোদ আসে না ঘাটে, সেই কনকনে হিমজলে বসে বাসন মাজা, যেমন তেমন ক’রে মাজলে তো এ বাড়িতে চলবে না, কোথাও দাগ থাকবার জো নেই একটু, জ্যাঠাইমা দেখে নেবেন নিজে। সে যে কি কষ্ট হয় মায়ের, মা মুখ বুজে কাজ করে যান, বলেন না কিছু, আমি তো বুঝতে পারি। ওসব কাজ কি মা করেছেন কখনো ? সকলের চেয়ে কাজ বাড়ে পুজোআচ্চার দিনে-এ বাড়িতে বারো মাসের বারোটা পূর্ণিমাতে নিয়মিত ভাবে সত্যনারায়ণের সিন্নি হয়। গৃহদেবতা শালগ্রামের নিত্যপূজা তো আছেই। তা ছাড়া লক্ষ্মীপূজা মাসে একটা লেগেই থাকে। এসব দিনে সংসারের দৈনিক বাসন বাদে পূজোর বাসন বেরোয় ঝুড়িখানেক। এদের সংসার অত্যন্ত সাত্ত্বিক গোড়া হিন্দুর সংসার—পুজোআচ্চার ব্যাপারে পান থেকে চুন খসবার জো নেই। সে ব্যাপারের দেখাশুনে করেন জ্যাঠাইমা স্বয়ং। ফলে ঠাকুরঘরের কাজ নিয়ে যারা খাটাখাটুনি করেন, তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। পূজোর বাসন যেদিন বেরোয়, মা সে-দিন সীতাকে সঙ্গে নিয়ে যান ঘাটে। সে যতটা পারে মাকে সাহায্য করে বটে, কিন্তু একে সে ছেলেমানুষ, তাতে ও সব কাজ তার অভ্যেস নেই একেবারেই। জ্যাঠাইমার পছন্দমত পূজোর বাসন মাজতে সক্ষম হওয়া মানে অগ্নি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়—বরং বোধ হয় শেষেরটাই কিছু সহজ । জ্যাঠাইমা বলবেন,—কোষাকুষি মাজবার ছিরি কি তোমার সেজোবে ? কতদিন বলে দিইচি তামার পাত্তরে তেঁতুল নেবু না দিলে ম্যাড়ম্যাড় করবেই—শুধু বালি দিয়ে ঘষলে কি আর—ঠাকুরদেবতার কাজগুলোও তো একটু ছেদ ক’রে লোকে কয়ে ? সবতাতেই থিরিস্টানি— মা জবাব খুঁজে পান না। যদি তিনি বলতে যান—“না বড়দি, নেবু ঘষেই তো ঠাকুরঘরের তামার বাসন বরাবরই—“ জ্যাঠাইমা-বাধা দিয়ে বলবেন,—আমার চোখে তো এখনো ঢালা বেরোয়নি সেজবৌ ? অম্বলতা দিয়ে বাসন মাজলে অমনি ছিরি হয় বাসনের ? কা’কে শেখাতে এসেচ ? কি বলব, ভুবনের মা হেঁসেলের কাজ সেরে সময় করতে পারে না, নইলে বাসন-মাজা কা'কে বলে— জ্যাঠাইমা নিজের কথার প্রতিবাদ সহ করতে পারেন না, আর কেনই বা পারবেন, তিনিই যখন এ বাড়ির কত্রী, এ বাড়ির সৰ্ব্বেসৰ্ব্ব, পুত্রবধূরা, জায়ের, ভাগ্নেবে, মাসীর দল, পিসির দল, সবাই যখন মেনে চলে—ভয় করে । আমার ইস্কুলের পড়াটা শেষ হয়ে গেলে বাচি, এদের হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে অন্ত কোথাও চলে যাই তাহলে । ভুবনের মা সকালে আমাকে ডেকে বলল, জিতু, তুমি যখন ইস্কুলে যাও, ভুবনকেও নিয়ে ষেও না ? ওর লেখাপড়া তো হ’ল না কিছু, আমি মাসে মাসে আট আনা মাইনে দিতে পারি, জিজ্ঞেস করে এসো তো ইস্কুলে, তাতে হয় কিনা ? আমি বললাম—দেবেন কাকীমা, ওতেই হয়ে যাবে, ওর তো নিচু ক্লাসের পড়, আট আনায় খুব হবে। ভুবনের মা আঁচল থেকে একটা আধুলি বের করে আমার দিতে গেল। বললে—তাহলে নিয়ে রেখে স্থাও আর আজ ভাত খাওয়ার সময়ে ভুবনকে ডেকে খেতে বসিও। ও আমার কথা শোনে ন-তুমি একবার ইস্কুলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে ভৰ্ত্তি করে দিলে তারপর