পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ Ꮌ8Ᏹ করেই গেলুম সেখানে। মাস দুই পরে, গ্রাম ঠাণ্ডা হয়েছে, কেবল শুনলুম হিরন্ময়ীরা একঘরে হয়ে আছে। হিরন্ময়ী আগের মতই ছুটে এল আমি এসেছি শুনে । এখানে ওর চরিত্রের একটা দিক আমার চোখে পড়ল—লোকে কি বলবে এ ভয় ও করে ন—এখানে মালতীর সঙ্গে ওর মিল আছে। কিন্তু মালতীর সঙ্গে ওর তফাৎও আমি বুঝতে পারি। হিরন্ময়ী যেখানে যাবে, সেখানে পেছন ফিরে আর চার নী—মালতীর নানা পিছুটান । সবাই সমান ভালোবাসতেও পারে না । প্রেমের ক্ষেত্রেও প্রতিভার প্রয়োজন আছে। খুব বড় শিল্পী, কি খুব বড় গায়ক যেমন পথেঘাটে মেলে না—খুব বড় প্রেমিক বা প্রেমিকাও তেমনি পথেঘাটে মেলে না। ও প্রতিভা যে যে-কোন বড় স্বজনী-প্রতিভার মতই দুর্লভ। এ কথা সবাই জানে না, তাই যার কাছে যা পাবার নয়, তার কাছে তাই আশা করতে গিয়ে পদে পদে ঘা খায় আর ভাবে অন্ত সবারই ভাগ্যে ঠিকমত জুটছে, সে-ই কেবল বঞ্চিত হয়ে রইল জীবনে। নয়ত ভাবে তার রূপগুণ কম, তাই তেমন ক’রে বাধতে পারে নি। হিরন্ময়ীর তমুলতায় প্রথম যৌবনের মঞ্জরী দেখা দিয়েছে । হঠাৎ যেন বেড়ে উঠেছে এই দু মাসের মধ্যে । আমায় বললে—কখন এলেন ? আসুন আমাদের বাড়িতে। মা বলে দিলেন আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে। কতদিনের ছুটি দিয়েছিলেন পাঠশালাতে, দেড় মাস পরে খুললো ? —ভাল আছ হিরণ ? উঃ, মাথায় কত্ত বেড়ে গিয়েছ ? —এতদিন কোথায় ছিলেন ? বেশ তো লোক । সেই গেলেন আর আসবার নামটি নেই ? হয়ত দু-বছর আগেও এ কথা কেউ বললে বেদনাতুর হয়ে ভাবতাম, আহ, দ্বারবাসিনীতে ফিরলে মালতীও আমায় এরকম বলত। কিন্তু সময়ের বিচিত্র লীলা । এ সম্পর্কে মালতীর কথা আমার মনেই এল না। দু-দিন কামালপুরে রইলাম। হিরন্ময়ী একথা ভাবে নি যে, আমি আমার জিনিসপত্র আনতে গিয়েছি ওখানে, সে ভেবেছিল আমি আবার পাঠশালা খুলব । ওখানেই থাকব । এবার কিন্তু সে আসবার সময় তর্ক, ঝগড়া করলে না, যেমন ক’রে থাকে। শুধু শুকনো মুখে এসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখল আমার যাওয়া । ওর সে আগেকার ছেলেমাকুষি যেন চলে গিয়ে একটু অন্য রকম হয়েছে। তবুও কত অনুরোধ করলে ওখানে থাকবার জন্তে—গ এখন ভাল হয়ে গিয়েছে, কেন আমি যাচ্ছি, গায়ের ছেলেরা তবে পড়বে কোথায় ? কামালপুর গ৷ পিছু ফেলেছি, মাঠের রাস্তা, গরুর গাড়ি আস্তে আস্তে চলেছে। কি মন খারাপ যে হয়ে গেল ! মাঠের মধ্যে কচি মটর শাক, খেসারি-শাকের শুামল সৌন্দৰ্য্য, শিরীষগাছের কাচা শুটি ঝুলছে। বামুদেবপুরের মরগাঙের ভাগাড়ে নতুন ঘাসের ওপর গরুর দল চরে বেড়াচ্ছে। হিরন্ময়ীর নিরাশার দৃষ্টি বুকে যেন কোথায় বিধে রয়েছে, খচ, থচ ক’রে বাজছে। বেলা যায়-যায়, চাকদার বাজার থেকে গুড়ের গাড়ির সারি ফিরছে, বোধ হয় বেলে কি চুয়াডাঙ্গার বাজারে রাত কাটাবে। জীবনটা কি যেন হয়ে গেল, এক ভাবি আর হয় এক, কোথায় চলেছি আমিই জানি নে । কেনই বা অপরের মনে এত কষ্ট দিই ? এই রাঙা রোদমাখানো মটর-মুমুরির মাঠ যেন বটেশ্বরনাথের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সন্ধ্যায় গঙ্গার বুকে বড় বড় পাল তুলে নৌকোর সারি মুঙ্গেরের দিকে যেত, আমি মালতীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাষাণ-বাধানো ঘাটের ওপর বসে বসে অন্তমনস্ক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতুম। সব মিথ্যে, সব স্বপ্ন। ঐ মরগাঙের ওপারে জমা সন্ধ্যার কুয়াশার মত—ফাক, দু-দিনের জিনিস । এখানে ফল পাকে না। জেরুসালেম পাথরের দেশ ।