পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

వరి రి বিভূতি রচনাবলী মাথার ওপর সেখানে নীল আকাশ, সবুজ গাছপালাও চোখে পড়ে, পাখীর ডাকও শুনা যায়— এমন বিশ্ৰী আওয়াজ তো সে সব জায়গায় শুনে নাই। এমন কঠিন ইটের দেওয়াল দিয়া ঘেরা নয় সে জায়গা । পার্থীর কথায় বুধীর মনে পড়িল অনেকদিন আগেকার এক ঘটনা। কতদিন আগে তাহ সে বলিতে পারিবে না । মাঠের ধারে সে ঘাস খাইতেছিল ; একটা কি পাখী বনের ডাল হইতে উড়িয়া আসিয়া তাহার শিংএর উপর বসিল । শিংএর উপর পাখী বসা সে পছন্দ করে না—সুতরাং শিং নাড়া দিতেই পাখীট উড়িয়া বসিল তাহারই সামনেকার উলুঘাসে ভরা বাচড়ার উপর। তখন উলুঘাসের শীষ গজাইয়াছে, শীষের মাথায় সাদা সাদা ফুল অজস্র অজস্র। পাখীটা সেই উলুফুলের মধ্যে বসিয়া পালক ফুলাইয়া পায়চারি করিতে লাগিল। কি সুন্দর গায়ের রং, কি নরম নরম রঙীন পালকের বোঝা তার গায়ে, কেমন রঙীন ঠোটখানি । বুধীর মন মুন্দর পাখীটার প্রতি ভালবাসায় ভরিয়া গেল। সুতরাং খানিকট পরেই যখন পাখীটা আবার তার শিংএর উপর চড়িয়া বসিল, এবার সে শিং নাড় দিল না। এই রকম করিয়া পাখীটার সঙ্গে তার ভাব জমিয়া গেল। পার্থীটার ভাষা ছিল তার শিংএর উপর চটুল পা দুইখানির নীচুনি—কত নির্জন রৌদ্রভরা দুপুরে বুধী হয়ত মাঠে দাড়াইয়া উত্তাপে ও তৃষ্ণায় ঝিমাইতেছে—অমনি ছোট পাখীটা নিকটবর্তী বনভূমি হইতে উড়িয়া তাহার শিংএ আসিয়া বসিত। বুধীর নিঃসঙ্গতা অমনি দূর হইয়া যাইত—তাহাদের কত কথা কত গল্প চলিত সন্ধ্যা পৰ্য্যস্ত—তারপর নামিত অন্ধকার । বুড়ী আসিয়া খোটা উপড়াইয় তাহাকে বাড়ি লইয়া যাইত —পাখী যাইত উডিয়া । একদিন সেই মাঠে ফাদ পাতিয়া কাহারা পাখী ধরিতে আসিল । পোষা ডাহুকের ডাক শুনিয়া বন্য পার্থীটা খাচার নিকটে যাইতেই ফঁাদে পড়িয়া গেল । শিকারীরা তাহাকে খাচায় পুরিয়া লইরা চলিয়া গেল। যাইবার সময়ে ছোট পার্থীটার কি করুণ আৰ্ত্তনাদ । মাঝে মাঝে বুধীর সস্তান হইত। বেশ ছোট ছোট বাচ্চাগুলি ছুটিয়া, লাফাইয়া, নাচিয় বেড়াইত সারা মাঠ। প্রথম প্রথম তাহাদের বড় ভাল লাগিত কিন্তু বড় হইয়া গেলে তাহারা কোথায় চলিয়া যাইত—তাহদের কথা বুধীর আর বড় একটা মনে পড়িত না । -“কত কথাই মনে হয়। এই বিকট আওয়াজে ভরা নোংরা, কুত্ৰ ইটের দেওয়ালে ঘেরা এই জায়গাটা—আজি ক'দিন আসিয়া সে মরিয়া যাইতেছে...আর একটা ব্যাপার. বুধী রক্তের গন্ধ পায় কেন এখানে! সন্দেহের সহিত সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়াছে, কিছু টের পায় নাই, তবে দূর হইতে রক্তের গন্ধ ভাসিয়া আসে তাহা সে বেশ বুঝিতে পারে। প্রথম প্রথম তাহার মনে হইত–এও এক রকমের পাউণ্ড ঘর—একদিন বুড়ীর ছেলে আসিয়া তাহাকে বাড়ি লইয়া যাইবে। কিন্তু পাউণ্ড ঘরের অভিজ্ঞতা হইতে বুধী জানে যে, সেখানে একদিন বা বড় জোর দু'দিন থাকিতে হয়—তার পরেই বুড়ীর ছেলে আসিত দড়ি হাতে তাহাকে বাড়ি লইয়া যাইতে । আর এখানে আসিয়াছে আজ পাচ-ছ'দিন কি তারও বেশী। না—এ পাউণ্ড ঘর নয়, তার চেয়েও গুরুতর বিপদে এবার সে পড়িয়াছে। দিনের পর দিন কাটিতে লাগিল। আর একটা জিনিস বুধী লক্ষ্য করিয়াছে আজ ক'দিন। প্রতিদিন বৈকালে দু'জন লোক আসিয়া এই গরুর ভিড়ের মধ্যে বাছিয়া বাছিয়া কয়েকটি গরুর গায়ে কি কি ছাপ মারিয়া যায়—পরদিন শেষ রাত্রের দিকে সেই গরুগুলিকে কোথায় যেন লইয়া যায়—তারা আর ফেরে না । কেন ফেরে না, কোথায় ষায় তারা ?