পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૦૨ বিভূতি-রচনাবলী বুধী উন্মাদের দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিল। কাঠরায় ঢুকিবার কাঠের মোটা গরাদে বসানো নীচু ফটকাট বন্ধ। নিকটে কেহ কোথাও নাই! পাড়াগায়ে সে মানুষ, উচু উচু বাশের বেড়া টপকানো তার আজীবন অভ্যাস—এক লাফে ফটকট ডিঙাইয়া সে কাঠরার বাহিরে আসিল । তারপর বড় উঠান পার হইয়া বড় ফটকের নিকট পৌছিল—সেটাও খোলা । সে ছুটিতে ছুটিতে বড় ফটকটাও পার হইয়া গেল । পরবর্তী পনের মিনিটের কথা তাহার ঠিক স্পষ্ট মনে নাই—চওড়া রাস্ত—লোকের ভিড় —বড় বড় এক ধরনের গাড়ি রাস্ত দিয়া ছুটিতেছে—বড় বড় বাড়ি,—একটা খাল—একটা পুল —আরও লোকজন—একজোড়া মহিষ—সেই বিকট আওয়াজ সৰ্ব্বত্র—দিশহারার মত ছুটিতে ছুটিতে বুধী রাস্তার পর রাস্ত পার হইতে লাগিল—কত রাস্তা ! এদেশে রাস্তার কি শেষ নাই ? আবার বাড়িঘর–আবার রাস্তা—দু'দুবার সে গাড়ি চাপা পড়িতে পড়িতে বাচিয়া গেল ! আবার বড় একটা পুল—দূরে রেলগাড়ি যাইতেছে—রেলগাড়ি সে চেনে—তাহাদের গ্রামে দক্ষিণ মাঠে ট্যাংরার ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়া বাধা উচু সড়ক বাহিয়া রেলগাড়ি যায়। এখানে উপরে রেলরাস্তা—নীচে দিয়া রাস্তা—ছুটিয়া পুলের তলা দিয়া সে রেলরাস্তাও পার হইল –আবার দৌড়। “দৌড় ! বৃদ্ধ শরীর, সে হাপাইয়া পড়িল। যখন তাহার দিশেহারা ভাবটা কাটিয়া জ্ঞান ফিরিয়া আসিয়াছে, তখন সে দেখিল একটা জলার ধারে খুব বড় মাঠের মধ্যে সে এক দাড়াইয়া। সামনের প্রকাণ্ড জলাটি কচুরিপানায় বোঝাই, সেখান দিয়া পথ বন্ধ । আর ভিড় নাই, রাস্তার গোলকধাঁধা নাই, গাড়ির ঘড়ঘড় আওয়াজ নাই। এখানে অনেক দূর পৰ্য্যন্ত আকাশ দেখা যাইতেছে—হু হু হাওয়া বহিতেছে জলার দিক হইতে যেন তাহাদের গ্রামের নদীর ধারের মাঠের মত । মুক্ত ! মুক্ত ! সে মুক্ত ! তবু নিজেকে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করিতে পারিল না—স্থির হইয়া এক জায়গায় দাড়াইতে পারিল না । কি জানি যদি লোকজন আসিয়া আবার তাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া পাচিল-ঘেরা বড় বাড়িটায় পুরিয়া রাখে ! বহু ঘুরিয়া পরে সে ক্লান্ত হইয়া একটা গাছতলায় রাত্রির জন্ত আশ্রয় লইল । সে শুইয়৷ পড়িল একেবারে—কোনদিকে লোক নাই, তবু সে ভাল ঘুমাইতে পারিল না। যখন ঘুম ভাঙিল, তখন ভোর হইয়াছে। সে চলিতে আরম্ভ করিল। দুপুর পর্য্যস্ত দিগভ্রান্তের মত এদিক ওদিক কতদিক ঘুরিতে ঘুরিতে একটা গাছের তলায় দাড়াইয়াছে, হঠাৎ তাহার মনে হইল দূরে যে বড় রাস্ত চলিয়া গিয়াছে—যার দু’ধারে বড় বড় গাছের ছায়া—ওই রাস্ত সে ইতিপূৰ্ব্বে আর একবার দেখিয়াছে ! সেদিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিতে তাহার মনে পড়িল—অদ্ভুতভাবে পুরানো স্মৃতিটা মনে পড়িল হঠাৎ ! ওই রাস্তাটা দিয়াই তাহাদের একটা বড় দলের সঙ্গে সে আসিয়াছিল মাসখানেক আগে ! সেই রাস্তাটা ! - বুধী ছুটির গিয়া বড় রাস্তাটয় উঠিল। ই, ঠিক চিনিতে পারিয়াছে, সেই রাস্তাটাই তো! কোনো ভুল নাই। সে অভিভূতের মত দাড়াইয়া রহিল—মুক্তি মিথ্য, এত প্রচুর নরম কচি ঘাস মিথ্য, নীল আকাশের তলায় বড় বড় মাঠের নিরঙ্কুশ, নিরাপদ নিৰ্জ্জনতা আর হু-হু উন্মুক্ত হাওয়া সব মিথ্যা—যদি সে তাহার আজন্ম সুপরিচিত সেই গ্রামটিতে না ফিরিতে পারে, ছোট্ট খুকীর দুটি ছোট্ট স্নেহ-হস্তের স্পর্শ পুনরায় সে না পায় ।