পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী راہ $ এতটুকু সহানুভূতি সে স্বজাতীয়ের কাছে আশা করিতে পারে না ? আবার ভিখিরী বলিয়া অপমান করা ? গ্রামের বাহিরে আসিয়া সে হাড়ে হাড়ে বুঝিতেছে জগৎ কি নিষ্ঠুর । তখন অন্ধকার খুব ঘন হইয়াছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, গাছতলার মধ্যে জোনাকী জলিতেছে। মশায় খাইয়া ফেলিয়া দেয় বলিয়া বুধী এই সব গাছতলায় শুইতে পারে না যেখানে সেখানে। সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর তাহার ভাঙিয়া পড়িতে চাহিতেছে। বরাবর তাহার সাজালের ধোয়ায় শোয়ার অভ্যাস । এই সময়ে প্রতিদিন মনে পড়ে তাহার আবাল্য পরিচিত নিজস্ব গোহাল ঘরটির কথা । তাহার ক্ষুদ্র জগতের কেন্দ্র সেখানে । সেই তাহার গৃহ। আজ তারই অভাবে সে গৃহহীন, ছন্নছাড়া হইয়া পথে পথে বেড়াইতেছে । আর কখনো কি সেখানে ক্লান্ত শরীরকে এলাহয় দিবার সৌভাগ্য তাহার ঘটিবে ? গ্রামের বাহিরে ফাক মাঠে তবুও মশা অনেক কম। এইখনেই একটু ভাল জায়গা দেখিয়৷ বুধী শুইয়া পড়িল । খানিক রাত্রে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। মাঠের মধ্যে ফেউ ডাকিতেছে। বাঘ বাহির হইলেই ফেউ ডাকে, বুধীর জানা আছে। ভয়ে তাহার শরীর অবশ হইয়া গেল— সৰ্ব্বনাশ! যদি বাঘ আসিয়া পড়ে ? যদি তাহাকে দেখিতে পায় । সারারাত দূরে দূরে কেউ ডাকিল। বুধীর ঘুম হইল না। একবার ভাবিল গায়ের মধ্যে কোন গোহালে গিয়া আশ্রয় লওয়া যাক। পরক্ষণেই ভাবিল, পরের টিটকারী সে সহ করিতে পরিবে না—বিশেষতঃ স্বজাতীয়দের ঠাট্টrবিদ্রুপ অসহ—তার চেয়ে বাঘের পেটে যাওয়া ভালো । শেষ জীবনে এত দুর্দশাও তাহার কপালে ছিল ! কেহ ভালবাসে না, কেহ এক আঁটি বিচালি দিয়া আদর করে না, আপনার জন বলিতে কেহ নাই—যাহারা ছিল, তাহারা যে কোথায়, কত দূরে, কোন দিকে—কে তাহাকে পথনির্দেশ করিবে ? পথে পথে যে কতদিন কাটিল বুধীর তাহার হিসাব নাই । কত মাঠ, কত গ্রাম, কত বিলবাওড়ের ধারের বাবলা বন, কত কচুরীপানায় ভত্তি মজাগাঙ। কচুরীপানার পাতা খাইলে মুখ চুলকায় সবাই জানে, বুধী কখনো এর আগে খায় নাই—কিন্তু সব জায়গার ঘাস ভাল নয় —বিশেষত বন্যায় ডোবা পচা ঘাস খাইলে গলা ফুলিয়া মারা পড়িতে হয়, একথা বুধী জানে। বাধ্য হইয়া সুতরাং কচুরীপানার পাতাই এবার খাইতে হইল। এক জায়গায় পথের ধারে একটা কামারের দোকান। চাষালোক লাঙ্গলের ফাল জোড়াইতে আসিয়াছে। বুধীকে দেখিয়া একজন লোক বলিল—গরুডো কাদের হা ? আর একজন বলিল--ফয়জদি বিশ্বেসের গোরুডোর মত দেখ,তি—না মামু? পুৰ্ব্বের লোকটি বলিল—সে তো ধুজি শিংয়ে গাই—এডার মত নয়। বুধকে একজন আসিয়া ধরিয়া ফেলিল। বুধী তখন অত্যন্ত ক্লান্ত, সাধ্য নাই যে পালায়। সবাই মিলিয়া দেখিয়া বলিল-এড ভিন্‌ গায়ের গরু, ছাড়ান দাও, কি কত্তি কি হবে, দরকার কি পরের গরু বেঁধে, শেষকালে কি একটা থানা-পুলিসির হাংগামায় পড়তি যাবা ? ছাড়ান দাও । দলের মধ্যে একটা লোক ছিল, সে মামুষের মত মানুষ, তার হৃদয় আছে। সে বলিল, আহা কাদের গোরুডো ? হাড়সার হয়ে গিয়েচে । এড বোধ করি মামু, চালানের পাল থেকে পালিয়ে আসচে। বাড়ি নিয়ে দু'টো সানি খেতে দিইগে—তারপর ছাড়ান দেবানে । কিন্তু অন্ত লোক তাহাকে বাধা দিল । বাড়ি লইয়া যাইতে দিল না। বুধী সেখান হইতে গ্রামের বাহিরের রাস্ত ধরিল । তারপর একদিন আসিল ভীষণ বিপদ । বুধীর ভীষণ তৃষ্ণ পাইয়াছে—কোথাও জল পায় না। অবশেষে একটা কি নদী পাওয়া গেল। তৃষ্ণায় তাহার ছাতি ফাটিয়া যাইতেছে—সে জলের ধারে জল খাইতে গিয়া নরম পাকে পুতিয়া