পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রূপহলুদ ২৮৭ —ঐটেই তো আমায় ভাবিয়ে তুলেচে । কোনো হদিস করে উঠতে পারছি না। সতীশ চলছিল রাস্তার নাম দেখতে দেখতে । হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠল—পেয়েছি। এই গলি । সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে সেই গলির পানে তাকিয়ে আমার সারা শরীর—কেন জানি না— একপ্রকার শিহরণ জাগল । চীনাপল্লীর চীনা-আবহাওয়ায় রহস্যজনক খাট ! সতীশের হাতটা ধরে বললাম—থাটে কােজ নেই সতীশ, চল ফিরে যাই । আমার বাঙালী-খাট বেঁচে থাকুক। সতীশ প্রবলবেগে এক বাঁকানি দিয়ে উঠল—ভীতু কোথাকার! এতটা এগিয়ে এসে কখনও ফেরা যাবে না । গলির মোড়ে ডান পাশে একটা নিমগাছ ভূতের মত মাথা উচু করে দাড়িয়ে ছিল। ওদিকের ডাস্টবিনের মধ্যে থেকে যত সব অখাদ্য-কুখাদ্যের উৎকট গন্ধ ভেসে আসছে। অন্নপ্রাশনের ভাত যেন ঠিকৃরে বার হয়ে আসতে চাইল অসহ যন্ত্রণায় ! নাকে রুমাল চাপা দিয়ে কোনগতিকে পথ চলতে লাগলাম । একটা দমকা বাতাস বিভ্রান্ত হয়ে আচমকা দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে এসে আমাদের শরীরে যেন আছাড় খেয়ে পড়লো। মাথার উপর দিকে কয়েকটা বাদুড় ডানার শব্দ করতে করতে উড়ে গেল। দুটো অভিভাবকহীন কুকুর এই অনধিকার প্রবেশকারীদের পানে চেয়ে বিত্র সুরে অভিযোগ করতে লাগল। পথে আর জনমানবের চিহ্ন পৰ্য্যন্ত ছিল না। পাশে একটি চীন-ডাক্তারের বহু পুরাতন সাইন-বোর্ড। তার উপরকার নরকঙ্কালের ছবিটি জীর্ণপ্রায় । কোথা থেকে একটি পিয়ানোর অস্পষ্ট সুর ভেসে আসছিল। শীঘ্রই আমরা আমাদের নির্দিষ্ট গৃহে এসে পৌঁছোলাম। অমন বাড়ি আমি আর জীবনে দেখিনি। ইট বার করা পসুপ্রায় বহু প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে দাত বার করে দাড়িয়ে আছে। হয়তে নবাব আলিবর্দি খাঁর আমলে এই বাড়ির ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল । ভাঙা ফটক দিয়ে অতি সন্তপণে ভিতরে প্রবেশ করলাম । বাড়ির ভেতরে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত লোক এখানে কোথা থেকে এল ? যে নির্জন নিস্তব্ধ গলি আমরা পিছু ফেলে আসলাম, সেখানে তো কারুর ছায়া পৰ্য্যন্ত খুজে পাইনি। ভৌতিক কাণ্ড নাকি ? সকলের মুখেই কৌতুহলের ছাপ বৰ্ত্তমান। নানা জাতির লোক সেখানে সমবেত হয়েছিল। এতগুলি লোক, কিন্তু কারুর মুখে একটি কথা নেই। ছুচ পড়লে পর্য্যন্ত তার শব্দ শোনা যায়। ঘণ্টাখানেক পর একটি বৃদ্ধ মোট চীনা আমাদের পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেল। তার মাথার একটি চুলও কাচ ছিল না। তার সামনের ওপরের দুটি দাত সোনা দিয়ে বাধানে, আর বঁ হাতের উল্কতে একটি ভোজালির ছবি । সে আমাদের ইশারা করে অনেকগুলি ঘর পার করে সেই থাটের ঘরে নিয়ে গেল। বাড়িটি একটি দুর্ভেদ্য দুর্গের মত—চারিদিকে গোলকধাঁধা । হ্যা, খাট বটে ! অমন খাট আমি জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। খাট আমি অনেক দেখেছি ; কিন্তু ঠিক ঐ রকম আশ্চৰ্য্য চীন-খাট সেই প্রথম এবং শেষ দেখলাম। তার অপূৰ্ব্ব ভাস্কৰ্য, অপূৰ্ব্ব কারুকার্য্য ! একপাশে ভগবান বুদ্ধের ধ্যান-গম্ভীর প্রশান্ত মূৰ্ত্তি। আয়তনে খাটটি বিশেষ বড় নয়। দুটি মানুষ বেশ আরামে শুতে পারে। আবার আশ্চৰ্য্য, সেই খাট বাড়িয়ে, দশজনের জায়গা করা যায় ! দেখে চমকে গেলাম। সকলের সঙ্গে দর-কষাকষি হতে লাগল। ঐ সামান্ত একটা কাঠের থাটের প্রতি সকলেরই মন আকৃষ্ট হয়েছিল। কেনবার জন্তে সকলের কি সে ব্যাকুলত । দাম হু-হু করে বাড়তে লাগল। শেষে সতীশের ভাগ্যেই ঐ খাটটি জুটল—পনরোশ টাকায়।