পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকৰ্ণ । ‘Le vවී টি ফার্ণ-শোভিত নিবিড় বনের মধ্যে। সত্যিকার ট্রপিক্যাল প্রকৃতির অরণ্যাণী এই প্রথম দেখলাম ডাওকির পথে । ডাওকিতে যখন মোটর পৌঁছল তখন অস্তদিগন্তের আভায় পৰ্ব্বত ও অরণ্যানীর শীর্ষদেশ রাঙা হয়ে উঠেচে—নিস্তব্ধ চারিদিক । মধ্যে নীচু উপত্যকায় ঘন ছায়া নেমেচে, গাছপালার সুগন্ধি বেরুচ্ছে, যেমন হেমন্তের অপরাহ্লে আমাদের দেশে বেরোয় । সুন্দর জায়গাট, দু-একটা ডাকবাংলা আছে টিলার মাথায় । সম্ভবতঃ অস্বাস্থ্যকর স্থান, পাহাড়ের নিম্নসামুতে সাধারণতঃ যেমন হয়ে থাকে। এখানে চ খেয়ে নিলুম, তারপর আবার মোটর ছুটল—শৈলমালা চলেচে মোটর রোডের সমান্তরাল ভাবে ব্যদিকে, অনেকগুলো ঝর্ণ নেমে আসচে পাহাড় থেকে নিম্নে বনানীর মাথার ওপর, দুধারে ছেটেখাটাে জঙ্গল আর জলাভূমি, বড় বড় নলখাগড়ার বন । মোটর ছুটেচে তীরবেগে, হু-হু হাওয়া বাধচে বুকে, তৃতীয়ার একফালি চাদ উঠেচে সামনের আকাশে। সন্ধ্যায় অন্ধকারেই জয়ন্তীপুর বলে একটা গ্রামের ডাকঘর থেকে ডাক তুলে নেওয়ার জন্তে গাড়ি সেখানে দাড়াল। সাড়ে সাতটায় সিলেটু টাউনে এল । টাউনটা আমার ভাল লাগল না—Read huts আর টিনের ঘর, সিনেমা—বেতের ও বাশের আসবাব বিক্রী হচ্ছে দোকানে। সময় খুব অল্পই ছিল, সুরমা নদীতে খেয়া পার হয়ে স্টেশনে এসে গাড়িতে চড়লুম। কি ভিড় গাড়িতে, আজই সব আপিস-আদালত বন্ধ হয়েচে, সব লোক ছুটেচে বাড়ি, পা রাখবার জায়গা নেই। কুলাউড়াতে আসবার পর কুলাউড়া আর শ্রীমঙ্গলের মধ্যে অনেক ছোট ছোট পাহাড় আর ঘন জঙ্গল, চা বাগানও নীচে আছে, কিন্তু অন্ধকারে কোনটা চা বাগান আর কোনটা জঙ্গল এ বোঝা বড়ই শক্ত। কুমিল্লাতে একদল ছেলে উঠল, তারা ময়নামতী সার্ভে স্কুলের ছাত্র, ছুটিতে বাড়ি চলেচে । ঘুম পেল না গাড়িতে, যদিও জায়গা যথেষ্ট ছিল । চাদপুরে স্টীমারে পানীয় জলের ট্যাঙ্কের ওপর বসে বেলা একটা পৰ্য্যন্ত কাটালুম। ডেকে পা রাখবার জায়গা নেই, সৰ্ব্বত্র লোকে বিছানা পেতে শুয়ে বসে আছে। পদ্মাবক্ষে কাটল প্রায় এগারো ঘণ্টা। ভাগ্যকুলে কিছু খাবার কিনে খাই । গোয়ালন্দ থামবার আগে সে কি ভীষণ বৃষ্টি আর ঝড় ! তাতেই স্টীমার দেরি করে ফেললে আসতে। চাটগা মেলে চড়ে বসে ভাবলুম এ তো বাড়ি এসেচি, আমাদের রানাঘাট দিয়ে যে ট্রেন চলে সে তো বাড়িরই সামিল । দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ হোল। খুব দীর্ঘ হয়তো নয়, কিন্তু দীর্ঘটা relative term, আমার কাছে এই ভ্রমণই খুব দীর্ঘ বটে। তা ছাড়া সুপ্রভাকে কতদিন দেখিনি, ওর আদর-যত্বে এবারকার ভ্রমণের স্মৃতি মধুর হয়ে থাকবে চিরকাল । ওখান থেকে ফিরে নলহাটি এসেচি কাল রাত্রে। রেল কোম্পানি জায়গাটা ভাল বলে যতই বিজ্ঞাপন দিক, আসলে জায়গাটা ভাল নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিক থেকে তো কিছুই না— শুধু ধানের ক্ষেত চারিধারে, একটু ডাঙা আছে, এখানকার লোকে বলে ‘পাহাড় —আমার মনে হয় সেটা একটা কাকর ও রাঙা মাটির ঢিবি । বৈকালের পড়ন্ত ছায়ায় দূর-প্রসারিত হামল ধান্তক্ষেত্রের শোভা দেখা গেল ডাঙাটার ওপর থেকে, কিন্তু এই পৰ্য্যন্ত, ওর বেশী আর কিছু নেই এখানে। জগধারী বলে একটা গ্রাম আছে দু'মাইল দূরে, ব্রাহ্মণী নদীর ধারে। সেখানে গুরুপদ সিংহের বাড়ি আমাদের নিমন্ত্রণ হোল। বীরভূমের এ অঞ্চলের ঘর-বাড়ির গড়ন আমাদের চোখে ভাল লাগে না। গৃহ-নিৰ্ম্মাণের শ্ৰী ছাদ নেই, সৌষ্ঠব নেই, চেরাপুঞ্জিতে খাসিয়াদের পাথরের বাড়িগুলোতেও যে রুচিজ্ঞানের পরিচয় পেয়েচি, এই সভ্য বাংলাদেশে তার নিতান্তই অভাব চোখে পড়ল। জগধারী গ্রামে এক ব্রাহ্মণবাড়ি দেখলুম। পটে দুর্গ পূজা হচ্চে।