পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকর্ণ Oyo —মনে এনে দেয় আফ্রিকার ট্রপিক্যাল অরণ্যের কথা, দক্ষিণ আমেরিকার অধ-মরু আধ-জঙ্গলে ভরা জায়গার কথা—নান বিরাট, জনহীন, বহুবিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক রাজ্যের ছবি । ওতেই এত ভাল লাগে দিগন্ত রেখার রাঙা ফুল-কোটা শিমূল গাছ, অথবা অৰ্দ্ধ-শুষ্ক থডের মাঠে ছোটখাটাে ঝোপের মধ্যে থেকে এক উঠেছে একটা বড় শিমূল গাছ—তবে শেষেরটা ভারী অদ্ভুত। মাঠে যদি আমন দেখি, তবে সেখানে বসে সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারি। মানুষের মন বড় অদ্ভুত জিনিস। লোকে মুখে যে কথাই বলুক, বা চিঠিতে যে কথাই যাকে লিখুক, তার মন সম্পূর্ণ অন্ত কথা বলে । মুখের কথায় আর মনের কথায় এই জন্যেই মিল প্রায় হয় না। হরিনাভি স্কুলের ছেলেরা ওদের re-unionএ এসেছিল বলতে, ওদিকে মণিবাবুর বাড়িও নিমন্ত্রণ ছিল, দুই কারণে এদিন রাজপুর স্টেশনে নেমে হরিনাভি গেলাম। বসন্তে গ্রাম্যশোভা দেখাই ছিল আমার আসল উদেশ্ব। তাই খররৌদ্র-দুপুরে বেগুনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার মধ্যে দিয়ে যে পথটা গিয়ে হরিনাভি স্কুলের কাছে মিশল, ওই পথটা দিয়ে গেলুম নেমে । খুব আম্র মুকুলের সৌরভ, লেবু ফুলের গন্ধ, ঘেটুবনের শোভা, কোকিলের ডাক, মাথার ওপর দুপুরের রোদ ঠিকৃরে পড়া নীল আকাশ। আপনমনে যাচ্চি, যাচ্চি, কত কালের পুরানো পথ, কতবার এ পথ দিয়ে এসেচি গিয়েচি, যখন হরিনাভি স্কুলে মাস্টারি করতুম। কণিবাবুদের বাড়ি নিমন্ত্রণ সেরে স্কুলে এলুম। প্রিয়নাথ ব্রহ্মচারী আমাদের বাল্যকালে স্কুল ইনস্পেক্টর ছিলেন, তাকে দেখলুম অনেক কাল পরে। স্কুলের ওদিকের আকাশটা আমার তথন-তখন বড় প্রিয় ছিল, আর পাচিলের ওদিকের গাছপালা, সভা ছেড়ে আমি তাই দেখতে উঠে গেলাম । তারপর ভোস্কলের সঙ্গে বেরিয়ে বৈকালের ছায়ায় একটা ছায়াভর পথ দিয়ে হঁটিতে হাটতে একটা মাঠের ধারে এসে বসলুম। স্বৰ্য্য তখন অস্ত যাচ্ছে, দুজনে বসে পুরোনো দিনের গল্প কতই করি। ওখান থেকে উঠে আরও কিছুদূর এসে একটা পুরোনো ভাঙা দোলমঞ্চের কার্মিসের ওপর সন্ধ্য পৰ্য্যন্ত বসে থাকি। দোলমঞ্চটার চারিধারে ভাঙা মন্দির পড়ার মধ্যে বলে চারিদিকেই আমবাগান, তার তলায় খুব ঘেটু ফুল ফুটেচে, একধারে একটা কামিনী ফুলের ঝাড়। নানা ফুলের সম্মিলিত সৌরভে সন্ধ্যার বাতাস ভরপুর। হুতুম-পেচা ডাক্‌চে প্রাচীন গাছের কোটরে । দু-একটা নক্ষত্র উঠেচে আমবনের ওপরে আকাশে । অন্ধকার হয়ে গেল। একটা পুকুরের ধারে এসেও খানিকট বসি । কাল সন্ধ্যাবেল নীরদবাবুর বাড়ি গিয়েছিলুম দুপুরে, প্রমোদবাবু অনেক দিন পরে কলকাতায় এসেচেন। অনেক গল্পগুজব করলুম। একদিন হিজলী যাওয়ার কথাও হল । ওখান থেকে পশুপতিবাবুকে ফোন করে জানলুম দিলীপ রায় কলকাতা এসেছে এবং আজ থিয়েটার রোডে ডা: প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বাড়ি সন্ধ্যায় গান হবে। হেমেনদা এলেন তার মেয়েদের নিয়ে। ওদেরই মোটরে ওদের সঙ্গে প্রতাপ মজুমদারের বাড়ি গেলুম। দিলীপের সঙ্গেও দেখা গেটের কাছেই । ওর সঙ্গে কখনও চাক্ষুষ আলাপ হয়নি, যদিও চিঠিপত্রে আজ আট ন বছরের আলাপ | নাম শুনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল, কি চমৎকার উদার স্বভাব দিলীপের । বড় ভালো লাগে ওকে। বহু বিশিষ্ট নরনারী এসেচেন দিলীপের গান শুনতে। আজ আট ন বছর পরে দিলীপ কলকাতায় এল। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, জীবনময় রায়, সৌরীন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বস্ব, শচীন্দ্র দেব বর্ষণ, উমা মৈত্র, পরিচয় কাগজের দল—অনেককেই দেখলুম। কেবল মনি বোসকে পাওয়া গেল না। আব্বাস তায়েবজীর মেয়ের কৃষ্ণ বিষয়ক গানটি আমার সকলের চেয়ে ভাল লাগল। আসল গানটা হিন্দীতে ছিল, দিলীপ বাংলাতে অনুবাদ করেচে। কি চমৎকার গাইচে দিলীপ আজকাল । বাংলা গানের অমন ঢং কোথাও আর কখনও শুনিনি।