পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২০ বিভূতি-রচনাবলী লোক দরজির কাজ করচে, তার সঙ্গে কথাবাৰ্ত্তা বলি বসে। এমন সময় দেখি আমার পুরোনো ক্লাসফ্রেণ্ড মনোরঞ্জন যাচ্ছে—তার সঙ্গে কাল সন্ধ্যায় ফর্মেসিতে সাক্ষাৎ হয়েছিল—আমার সঙ্গে দেখা হয়ে ও খুব খুশিই হল। কিন্তু আমার মন এই মেঘলায় যেন কিছুতেই ঠিক হয় না! পোস্টাপিস থেকে ফিরে শিলং ডেয়ারিতে দুধ খেতে গেলুম। বেশ ভাল দুধ দেয়, পরিষ্কার ঘরটা। জেল রোড আর পুলিস বাজারের মোড়ে দাড়িয়ে মেঘাচ্ছন্ন লুম্ শিলং-এর দিকে চেয়ে ভাবলুম আমাদের গ্রামে এতক্ষণ রোদে তেতে উঠেচে চারিদিক । মাঠে সোদালি ফুল ফুটেচে, ইছামতী নদীতে এই গরমে নেয়ে খুব তৃপ্তি হবে। তীব্র গরম দূর করে হঠাৎ বেলা তিনটের সময় কালবৈশাখীর মেঘ উঠবে, বড় শুরু হবে, গরম পড়ে যাবে, সবাই আম কুড়তে দৌড়বে। এই এপন বসে লিখচি, টিপ, টিপ, বৃষ্টি শুরু হয়েচে, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ । আমার ঘরের দরজা দিয়ে দূরে পাহাড়ের চূড, মেঘে ঢাকা কয়েকটি পাইন গাছ সম্পূর্ণ দেথা যাচ্ছে, হোটেলের চাকর ৩নং ও ৪নং ঘরের বাবুদের জন্তে গরম জলের বন্দোবস্ত করচে, জোড়হাটে বাড়ি এক আসামী ভদ্রলোক আমার সঙ্গে গল্প করচেন। কি বিশ্ৰী বৃষ্টি ! এখানে বসে রৌদ্রালোকিত বাংলা দেশ, তার মাঠে, কুঠার মাঠে বিকেলের ছায়ায় যোদালি ফুলের মেলা, সারাদিনের গরমের পরে জ্যোৎস্নার|ত্রে ইছামতীর স্নিগ্ধ জলে এক নির্জন ঘাটে নাইতে নাম, খুকুর আস্তে আস্তে আসা ওদের বাড়ির বেড়ার পাশ দিয়ে—এসব স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। বৃষ্টি জোরেই মাম্ল—শীত বেশ । আমাদের দেশের অগ্রহায়ণ মাসের মত শীত । কলকাতাও এর চেয়ে ঢের ভালো, সেখানে দুপুর রোদে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী যাওয়া চলত একমাস মর্ণিং স্কুলের সময় । বৌঠাকুরুণদের বাডিতে চা পান, কমল সরকারের গান—সেও যেন স্বপ্নের মত মনে হয়। কাল সন্ধ্যায় একবার ওয়ার্ড লেকে বেড়াতে গিয়েছিলুম, সেই টি ফার্ণ দুটো দেখলুম। খাসিয়া মেয়ের বেড়াতে এসেচে । ওখানে দড়িরে কাল কেবলই মনে হয়েছে সুপ্রভ। এখানে নেই । একবার মনে হল, সেদিন যে পানিতরে বেশ ক'দিন কাটিয়ে এসেছিলুম সেকথা । সেই চাদা কাটার বন, সন্ধ্যায় একট। তারা উঠল । তাই নিয়ে ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে সেই নক্ষত্ৰজগৎ সম্বন্ধে আলোচনা ৷ বৃষ্টি আরম্ভ হয়েচে একঘেয়ে । থামবার নাম নেই। এ যেন শ্রাবণ মাস। গরম আর স্বর্ঘ্যের আলোর জন্তে মন ইপিাচ্ছে । লাইউমক্রাতে সুনীলবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করতে গেলেও হত –কিন্তু সুপ্রভা না থাকাতে আমার কোন কাজে উৎসাহ নেই। কে বেরোয় এই বৃষ্টির মধ্যে ? ভেবেছিলুম একবার শিলং পিক্‌-এ উঠব—তাও গেলাম না। মজা এই যে এখানে এতগুলো লোক এসেচে হোটেলে—সবাই কেবল বসে বসে খাচ্চে আর শরীর সারাচ্চে—কোন কিছু দেখবার উৎসাহ নেই ওদের । খাসিয়া ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে বড় সাহেবীভাবাপন্ন হয়েচে । ওরা সাহেবদের ধরণে হাত নেড়ে আনন্দ জানায়—কাল সনৎ কুটিরের সামনে এক খাসিয়া ছোকরা তার বন্ধুকে বল্লে—Cheerio! কেন বাবু, তোদের মাতৃভাষায় কোন কথা নেই? গির্জা থেকে কাল রবিবার সন্ধ্যার সময় অনেকগুলো খাসিয়া মেয়েপুরুষ ফিরছিল । নিজের ধৰ্ম্মও এরা ছেড়েচে । এই শীত আর বৃষ্টির মধ্যে : বার উৎসাহ হচ্চে না । জোড়হাটের ভদ্রলোকটি তেল মাথচেন । আমায় বল্লেন, নাইবেন না ? বল্লুম—মাথাটা ধোব মাত্র । আজ এখন চলে যাব— বডড ঠাণ্ড লাগবে সারাদিন । Rain, Rain, go to Spain—কি একঘেরে পাইন বন আর বৃষ্টি, স্বৰ্য্যের আলো নইলে মুনীর বিকেলের ছায়া নামে না, পাখী ডাকে না, ফুলের সৌন্দৰ্য্য থাকে না—একঘেয়ে বৃষ্টির শব্দে