পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৮ বিভূতি-রচনাবলী এ কোন দেশে আছি! চেরা থেকে এসে চ খেয়ে ওয়ার্ড লেকে অনেকক্ষপ দাড়িয়ে রইলুম। খুকু এতক্ষণ ঘোলার গাঙে গা ধুতে নেমেচে । আমাদের দেশে নাট্যকাটার ফুল ফুটেছে—সে এক দেশ আর এই এক দেশ ! অনেককাল আগে এই গোধূলিতে একটা স্মৃতি জড়ানো আছে, পাইনবনের মধ্যে বসে সেটা মনে আনতে বেশ লাগে । সুপ্রভাদের ওখানে গিয়ে দেখি স্বপ্রভার বাবা এসেচেন সিলেট থেকে। আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্তে অপেক্ষা করছিলেন। ভারী চমৎকার লোক, এমন সরল, সদানন্দ, অমায়িক স্বভাবের ভদ্রলোক আমি কমই দেখেচি । অনেকদিন পরে সুপ্রভার ছোট বৌদিদির হাতের তৈরী ভ্যানিলা দেওয়া নারকোলের সন্দেশ খাওয়া গেল । সন্ধ্যার দেরি নেই। লুম শিলংএর পাইনবনে মেঘ জমেচে । পশ্চিম দিগন্তে কিন্তু অল্প একটু নীল আকাশের আঁচ-মেঘে রং লেগেচে, ওয়ার্ড লেকের ওপারে পূর্বদিকের বহু দূরের আকাশে জমেচে অন্ধকার । কেবল শুনি মোটরের ভেঁপু, কত গাড়ি যে যাচ্চে সামনে দিয়ে । খাসিয়া মেয়েরা গল্প করতে করতে যাচ্ছে। গির্জায় প্রার্থনা হচ্চে, সম্মিলিত ইংরিজী গানের সুর কানে ভেসে আসচে। তামি কাউন্সিল হাউসের সোপানে বসে আছি । কি জানি কেন এই সন্ধ্যায় কেবল আমাদের গায়ের কথা মনে পড়ে। এ যেন কোথায় এসেচি, কতদূর—মুপ্রভ না থাকলে একটুও ভাল লাগত না। আমরা যখন পৃথিবীকে ভালবাসি বলি—তখন ভেবে দেখিনে, অনেকেই ভালবাসি খুব সংকীর্ণ অত্যন্ত প্রিয় ও পরিচিত একটা জায়গা। সেখানকার গাছপাল, নদী, মাটি, লোকজন আমার কাছে বড় আদরের—তাই তাদের পেয়ে ও ভালবেসে মনে হয় এই পৃথিবীকে বড় ভালবাসি। আসলে সেই গ্রাম বা নগরটাই আমার পৃথিবী । এমন কি রোদ বা জ্যোৎস্না সেখানে যত মিষ্টি, অন্ত জায়গায় ঠিক ততটা নয়। আজ সকাল থেকে অত্যন্ত বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল, বেলা ১০ টায় বৃষ্টি ধরেচে। সুপ্রভাদের হোস্টেলে গিয়ে বল্লুম-আজই চলে যাব ! সুপ্রভা যেতে বারণ করলে, তবুও বলে এলুম, না আজই যাব। কিন্তু হোটেলে এসে আর যেতে ইচ্ছে হল না। ভাবলুম, সুপ্রভা বারণ করলে, আজ থেকেই যাই । দুপুরে সুপ্রভার বাবা, সুপ্রভা, বীণ, রেবা দেখি একেবারে আমার ঘরের মধ্যে উপস্থিত—আমায় মোটরে উঠিয়ে দিতে। রেবা চকোলেট ও ফুল এনেচে । ওদের সবাইকে দেখে এত আনন্দ পেলুম। তারপর সকলে মিলে গেলুম সুপ্রভাদের কলেজ ও হোস্টেল দেখতে । নতুন তৈরী বিরাট কাঠের বাড়ি, দেখবার মত জিনিস বটে। ওখান থেকে বীণদের বাড়ি গিয়ে চ, তালের ক্ষীর, তালের বড়, লুচি কতরকম খাবার খেলুম। সুপ্রভার মাকে দেখে বড় কষ্ট হল । আহ, এই বয়সে এই শোক পেয়েছেন, তাতে মেয়েমানুষ, মনকে বোঝানো ওঁদের পক্ষে খুবই শক্ত। সুপ্রভার বাবাকে যতই দেখেচি, ততই মুগ্ধ হচ্চি র্তার মনের স্তুৈৰ্য্যে ও প্রসারতায় । তিনি যত সহজে শোক জয় করতে পারচেন, সুপ্রভার মা তা পারচেন না। কাজেই তার মনে কষ্ট হয় । সন্ধ্যা হয়ে গেল। চাদ উঠেছে মেঘের ফাকে, দক্ষিণ বনের মাথায়। একটা সীমাহীন নক্ষত্র মিট্‌মিটু করচে লুম শিলংএর ওপারের আকাশে। গির্জা থেকে দলে দলে খাসিয়া মেয়ে-পুরুষ উপাসনান্তে বাড়ি ফিরচে। অনেকগুলি খাসিয়া মেয়ের বাঙালীদের ধরনে কাপড় পরা। তাদের দেখাচ্ছে ভালো । e শিলংএ একটা জিনিস নেই। এখানে কোন সংপ্রসঙ্গের চর্চা দেখলুম না কোথাও। না সাহিত্য, মা গান, না অন্ত কোন শিল্প। লোকেরা সব চাকুরিবাজ, নয়তো স্বাস্থ্যান্বেষী হাওয়া