পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকর্ণ v®ዓ6: পঞ্চাশ বছর পরের কলকাত কল্পনা করলুম। কেউ নেই এরা। কেউ নেই আমরা। সাধনা বোস প্রাচীন বৃদ্ধ হয়ে হয়তো বেঁচে আছে। তখন নতুন একদল উঠেচে, তাদের নাম কেউ জানে মা। জীবনে চিত্র্য-নাট্যপটে কত অদ্ভুত পরিবর্তন। গিরিশ ঘোষের স্কুলের প্রবীণা অভিনেত্রী বিনোদিনী আজও আছে । গঙ্গার ধারে বসে মালা জপ করে । এই তো জীবন—এই যাওয়া, এই আসা, এই পরিবর্তন। দেখতে বেশ লাগে । আমি সবটা মিলিয়ে দেথি—একটি চমৎকার সিনেমার ছবি । এই খুকু, এই স্বপ্রভা, বনসিমতলার ঘাট, আমি—কে কোথায় মিলিয়ে যাব। কুটুর বিয়ে হয়ে গেল গত বুধবারে ১৬ই অগ্রহায়ণ । জাহ্নবীকে আনতে গিয়েছিলুম—খুকুদের বাড়িতে গেলুম, কতক্ষণ গল্প করার পর বাইরে জ্যোৎস্ব উঠেচে দেখে বাইরে এলুম—ও বলে, ছাদে চলুন। ছাদে গেলুম, খুড়ীমা এল না দেখে ও বল্লে—ম এল না। দুজনে কত গল্প করলুম, নতুন ব্লাউজের গল্প, কি করে সেটা ছিড়ে গেল তাই নিয়ে হাসাহাসি। পরদিন দুপুরে গিয়েচি, কত গল্প, কেবল বলে, “বমুন বসুন’ । তারপর গাড়ি এসেচে, জাহ্নবীকে নিয়ে যাচ্চি, ও দেখি ছাদের ওপরে উঠেচে । আমি ওদের বাড়ি যাচ্চি দেখে নেমে এল । বাইরের দোর খুলে দিয়ে চলে গেল। তারপরেই পান হাতে করে এল । চায়ের কাপ যে আলমারিতে থাকে, সেখান থেকে টাকা দিলে। ও খুজে পায় ন—আমি খুঁজে বার করলুম। সারাপথ ট্রেনে কি আনন্দেই গেলুম। আনন্দেই ভোর। সে আনন্দের ভাবনা আর শেষ হয় না। জ্যোৎস্না-ভরা গত রাত্রির ছাদে কথা, ইছামতীর দৃপ্ত, ওর সেই নতুন রাউজের গল্প কেবলই মনে হয়। মামার বাড়ি যাবার আগে জাহ্নবীদের কলকাতা নিয়ে ঘোরালুম। মামার বাড়ি গেলুম সন্ধ্যার সময়। ভোর রাত্রে দধি-মঙ্গল হল। তখনও ঘুম ভেঙে উঠেই কি মুন্দর ভাবনা ! আনন্দের চিন্তাতেই ভোর । সারাদিন ওই একই চিন্তা । অন্ত চিন্তাই নেই । সেই রাত্রি, সেই জ্যোৎস্না-ভরা ছাদ, সেই ব্লাউজের গল্পের স্মৃতি। বিয়ে হয়ে গেল। তার পরদিন এক রকম কাটল । শুক্রবারে বৌ-ভাত । খুব জাক-জমকেই বৌ-ভাত হল। বিভূতির মা এলেন, বিষ্ণু এল বারাকপুর থেকে । শনিবার ওদের নিয়ে আবার বনগা। আবার কত কথা, কত গল্প। ও বল্লে, যা কিছু শিখেছি আপনারই জন্তে, আপনি কত বিধান, আমি তো কিছুই জানিনে কি করে যে আপনার সঙ্গে এমন হল ! দেখুন, সংসারের কোন কাজে মন বসাতে পারিনে—মন হু হু করে, কেবল ওই সব কথা ভাবি । আমি দেখলুম—আমারও তো ওই রোগ। অদ্ভুত ! অদ্ভুত। বয়ে, কোথাও তার আগে নিয়ে চলুন। জীবনে অনেক বেড়াব কিন্তু আপনার সাহচৰ্য্য তো আর পাব না . ভগবানের অতি দুপ্রাপ্য ও দুর্লভ দান এই জীবনের অমৃত-ধারা। পলে পলে, দণ্ডে দণ্ডে তা অনুভব করচি—আজ সাত বছর ধরে, ১৯৩৪ সাল থেকে। এর তুলনা নেই। এ আনন্দের বর্ণনা করতে পারি এমন ভাষা নেই। কতকাল চলে যাবে—তখন খুকুও থাকবে না, আমিও থাকব না—কে জানবে ইছামতী তীরের এক ক্ষুদ্র গ্রামে শেফালি-বকুল গাছের নিবিড় ছায়ার ছায়ায়, কত হেমন্তের দিনের সন্ধ্যায়, কত শীতের দিনের জ্যোৎস্নায় দুটি প্রাণীর মধ্যে কি নিবিড় প্রতির বন্ধন ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল! 變 আকাশে তার বার্তা লেখা থাকবে, সে গ্রামের বাতাসে তার গানের ছন্ন অশ্রত মুরে ধ্বনিত হবে, সেখানকার মাটির বুকে তাদের চরণচিহ্ন অদৃশু রেখায় আঁকা থাকবে চিরকাল অনাগত