পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ২৭ ঠাট্ট, বিদ্রুপ, শ্লেষের ব্যাপার—জংলীপনা থিরিস্টানি বা বিবিয়ান। মার সহগুণ ছিল অসাধারণ, মুখ বুজে সব সহ করতেন, কোনোদিন কথাটিও বলেননি। . ভরে ভয়ে ওদের চালচলন, আচারব্যবহার শিখবার চেষ্টা করতেন—নকল করতে যেতেন—তাতে ফল অনেক সময়ে হ’ত উণ্টে । আরও মাসকতক কেটে গেল। সেই ক-মাসে আমাদের যা অবস্থা হয়ে দাড়ালো, জীবনে ভাবিওনি কোনো দিন যে অত কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে। দু-বেলা ভাত খেতে আমরা ভুলে গেলাম। স্কুল থেকে এসে বেলা তিনটের সময় খেয়ে রাত্রে কিছু খাওয়ার ইচ্ছেও হত না । ভাত খেয়ে স্কুলে যাওয়া ঘটত না প্রায়ই, অত সকালে ম চালের যোগাড় করতে পারতেন না, সেটা প্রায়ই ধার ক’রে নিয়ে আসতে হত। সব সময় হাতে পয়সা থাকত না—এর মানে আমাদের চা-বাগানের শৌখিন জিনিসপত্র, দেরাজ, বাক্স–এই সব বেচে চলছিল—সব সময়ে তার খদের জুটত না । মা বৌমানুষ, বিশেষতঃ এটা অপরিচিত স্থান, নিজের শ্বশুরবাড়ি হলেও এর সঙ্গে এত কাল কোনো সম্পর্কই ছিল না—কিন্তু মা ও সব মানতেন না, লজ্জা ক'রে বাড়ি বসে থাকলে তার চলত না, যেদিন ঘরে কিছু নেই, পাড়ায় বেরিয়ে যেতেন, দু-একটা জিনিস বেচবার কি বন্ধক দেবার চেষ্টা করতেন পাড়ার মেয়েদের কাছে। প্রায়ই শৌধীন জিনিস, হয়ত একটা ভাল কাচের পুতুল, কি গালার খেলনা, চন্দনকাঠের ছাতপাখা এই সব—সেলাইয়ের কলটা ছোট কাকীমা সিকি দামে কিনেছিলেন । বাবার গায়ের ভারি পুরু পশমী ওভারকোটটা সরকাররা কিনে নিয়েছিল আট টাকায় । মোটে এক বছর আগে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বাবা সেটা তৈরি করেছিলেন । চাল না হয় একরকম ক’রে জুটলো, কিন্তু আমাদের পরনের কাপড়ের দুর্দশ ক্রমেই বেড়ে উঠছিল। আমাদের সবারই একথান ক’রে কাপড়ে এসে ঠেকেছে—তাও ছেড়া, আমার কাপড়খানা তে তিন জায়গায় সেলাই। সীতা বলত, তুই বড় কাপড় ছিড়িস দাদা! কিন্তু আমার দোষ কি ? পুরোনো কাপড়, একটু জোরে লাফালাফি করলেই ছিড়ে যেত, মা অমনি সেলাই করতে বসে যেতেন । g বাবা আজকাল কেমন হয়ে গেছেন, তেমনি কথাবার্তা বলেন না—বাড়িতেও থাকেন না প্রায়ই। তাকে পাওয়াই যায় না যে কাপড়ের কথা বলি। তা ছাড়া বাবার মুখের দিকে চেয়ে কোনো কথা বলতেও ইচ্ছে যায় না । তিনি সব সময়ই চাকরির চেষ্টায় এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু কোথাও এ পর্য্যন্ত কিছু জোটেনি। মাস-দুই একটা গোলদারি দোকানে খাতাপত্র লেখবার চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু এখন আর সে চাকরি নেই—সেজ জ্যাঠামশায়ের ছেলে নবীন বলছিল, নাকি মদ খেয়ে গেছে। কিন্তু এখানে এসে বাবা একদিনও মদ খেয়েছেন ব'লে আমার মনে হয় না, বাবা মদ খেলেই উৎপাত করেন আমরা ভাল করেই জানি, কিন্তু এখানে এসে পৰ্য্যস্ত দেখচি বাবার মত শাস্ত মানুষটি আর পৃথিবীতে নেই। এত শস্ত, এত ভাল মানুষ স্নেহময় লোকটি মদ খেলে কি হয়েই যেতেন ! চা-বাগানের সে-সব রাতের কীর্তি মনে হলেও ভয় করে । রবিবার। আমার স্কুল নেই, আমি সায়াদিন বসে বসে ম্যাজেণ্টা গুলে রঙ তৈরি করেছি, দু-তিনটে শিশিতে ভর্তি করে রেখেছি, সীতার পাঁচ-ছখানা পুতুলের কাপড় রঙে ছুপিয়ে দিয়েছি —ক্লাসের একটা ছেলের কাছ থেকে অনেকখানি ম্যাজেন্টার গুড়ো চেয়ে নিয়েছিলুম। সন্ধ্যার একটু পরেই খেয়ে শুয়েচি। কত রাত্রে যেন ঘুম ভেঙে গেল—একটু অবাক হয়ে চেয়ে দেখি আমাদের ঘরের দোরে জ্যাঠাইমা আমার খুড়তুতো জাঠতুতো ভাইবোনের দল, ছোটকাকা—সবাই দাড়িয়ে। মা কাদচেন-সীতা বিছানার সবে ঘুম ভেঙে উঠে বসে চোখ