পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৩৯e বিভূতি-রচনাবলী পান সেজে, বিছানা করে কেমন করে রাখত 1 কাছে বসে গল্প শুনতে চাইত। একদিন হঠাৎ "চম্পক জাগো জাগো' গানটার এক কলি গাইতেই আমার শিলং-এর কথা মনে পড়ল। সেই ঈস্টারের ছুটি, শিলং, কলেজের হোস্টেলে আমার নিমন্ত্রণ করেচে-স্বপ্রভার অসুখ, তবুও সে উঠে এল, আমি আমার রেডিওর নাটকটা পড়ব—জজ্জিন ঘন ঘন ঘরে ঢুকচে, বার হচ্ছে— এমন সময় ওরা গ্রামোফোনে রেকর্ড চাপালে, আমার মনের মধ্যে সত্যি কি যেন হয়ে গিয়েছিল গানের প্রথম কলিটী শুনেই—'চম্পক জাগো জাগো । কল্যাণীকে বল্লুম—গানটা শোনাও না । গানটা সে গাইলে । আমি বসে বহুদূরের কোন পাইনবনের স্বপ্ন দেখতে লাগলুম। স্বপ্রভা— পাইনবন, লুম্ শিলং-এর মেঘাবৃত শিখরদেশ। কল্যাণী ছেলেমানুষ কিনা, বলচে—আপনি চলে গেলে আমি বিছানা বাইরের ঘর থেকে উঠিয়ে ফেলব। মন কেমন করে, আপনার জায়গায় সেবার ছোট মামাকেও শুতে দিইনি— বলি, ছোট মামা ওঠ, অন্ত জায়গায় গিয়ে শোও—এসব আমি তুলব। এই সময় গৌরীকে এনেছিলুম বারাকপুরে ১৯১৮ সালে । কতকাল আগে । সেই বঁাশ বাগানে নিভৃত সন্ধ্যা নামত, বর্ষার দিনে টিপ, টিপ, বৃষ্টি পড়ত, বেশ মনে আছে। ‘বানের জলে দেশ ভেসেছে, রাখাল ছেলে তুই কোথা' গানটা করতুম ইছামতী থেকে স্নান করে উঠে সকালে । সময়ের দীর্ঘ বীথিপথ বেয়ে কত এল কত গেল ! গৌরী...১৯১৮ সালের আষাঢ় মাসের শেষে তাকে নিয়ে এলুম বারাকপুর। রজনী মামার সঙ্গে বসে তাসখেলা হরিপদ দাসের চওঁীমগুপে। "বানের জলে দেশ ভেসেচে রাখাল ছেলে তুই কোথা, রাঘব বোয়াল মাছের সাথে মুখ-দুঃখের কই কথা"...এই গানটা ছিল দিনরাত আমার মুখে । আমাদের পাড়ার ঘাট থেকে সকাল বেলা বর্ষা-স্নাত ঝোপঝাপের পাশ দিয়ে আসতে (যে ঝোপ থেকে এ বছর সুপ্রভার চিঠির জন্তে কত বনমল্লিকা তুলেছি এবং যে ঘাটটার নাম অনেক দিন পরে হয়েছিল বনসিমতলার ঘাট) ওই গানটা গাইতুম। তারপর সে সব দিন চলে গেল। অনেক মাস কেটে গেল। তারপর আবার বহু লোকের ভিড় গেল লেগে । কত লোক এল । তাদের কথা মনে হয় আজ ৷ এসেচে, কিন্তু ওদের মধ্যে চলে যায় নি কেউ —আছে সবাই। অন্নপূর্ণ আছে, স্বপ্রভা আছে, খুকু আছে। অদ্ভুতভাবে এরা সব এসেছিল। যায়নি কেউই। মন থেকে নয়, বার থেকেও নয়। ১৯৪৭ সালে তাই আজ ১৯১৮ সালের কথা ভাবচি। আজ স্বপ্রভার পত্র পেলাম। কত ভালো মেয়ে সে, আজও মনে রেখেচে । আর বছরে এ সময়ে মনে বড় কষ্ট ছিল । জীবনের মাঝে মাঝে এমন কতকগুলি হর্ষোজ্জল, হাসি অশ্রু ছলছল দিন আসে, যাদের কথা চিরকাল মনে তো থাকেই, এমন কি একটু নির্জনে একমনে ভাবলে সেদিনের অনুভূতিগুলো পৰ্য্যস্ত এখনি আবার মনে আলে—অতি সুস্পষ্টভাবে মনে আসে, যেমন সেদিনের বিস্ত গন্ধরাজি আবার আভ্রাণ করি, আবার সে সব দিনের জীবনের কুশীলবদের চোখের সামনে দেখতে পাই । এই রকম দিন আমার জীবনে যেগুলি এসেচে–তা চিন্তা করে দেখলুম কাল বসে। গোলমালে ওদের কথা মনে না থাকলেও দু'দশ বছর অন্তর মনে আসে হঠাৎ । সে সব দিনের আর একটা মজা আছে, তারা মস্ত বড় আশার বাণী, অজানার আনন্দ নিয়ে আসে—একটা কিছু যেন ঘটবে, দিনগুলি বৃথায় যাবে না−একটা এমন কিছু ঘটবে, বা জীবনে কখনো ঘটে নি