পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২ বিভূতি-রচনাবলী মাসতে দেখতে পেলাম । আমার ভারি রাগ হ’ল, অভিমানও হ’ল । নিজের সব খেয়ে-দেরে পেট ঠাণ্ড ক'রে এখন আসছেন । মাস্টারের কাছে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে গেলাম। সীতার দিকে চেয়ে দূর থেকে বললাম—বেশ দেখচি—আমার বুঝি আর ক্ষিদে-তেষ্টা পায় না ? কটা বেজেছে জানিস ? সীতা বললে—বাড়ি এল ছোড়দা, তোমার বইদপ্তর নিয়ে ছুটি করে এস গে— আমি বললাম—কেন রে ? সীতা বললে—এস না, ছুটির আর দেরি বা কত ? তিনটে বেজেচে । আমার মনে হ’ল একটা কি যেন হয়েচে। স্কুল থেকে বেরিয়ে একটু দূর এসেই সীতা বললে—বাবা মারা গিয়েচে ছোড়দা । আমি থমকে দাড়িয়ে গেলাম—সীতার মুখের দিকে চেয়ে সে যে মিথ্যে কথা বলছে এমন মনে হ’ল না । বললাম—কখন ? সীতা বললে—বেলা একটার সময়— নিজের অজ্ঞাতসারে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—নিয়ে গিয়েচে তো ? অর্থাৎ গিয়ে মৃতদেহ দেখতে না হয়। কিন্তু সীতা বললে—ন, নিয়ে এখনও কেউ যায় নি। মা এক কি করবে ?...জ্যাঠামশাই বাড়ি নেই—ছোট কাক একবার এসে দেখে চলে গেলেন— আর আসেন নি । মেজ কাকা পাড়ার লোক ডাকতে গেছেন। বাড়িতে ঢুকতেই মা বললেন—ঘরের মধ্যে আর—মড়া দুরে বসে থাকতে হবে, বোস এখানে । কেউই কঁদিছে না। আমারও কান্না পেল না—বরং একটা ভয় এল—একা মড়ার কাছে কেমন ক’রে কতক্ষণ বলে থাকব না জানি ! অনেকক্ষণ পরে শুনতে পেলুম আমাদের পাড়ার কেউ মৃতদেহ নিতে যেতে রাজী নয়, বাবা কি রোগে মারা গেছেন কেউ জানে না, তার প্রায়শ্চিত্ত করানো হয় নি মৃত্যুর পূর্বে —এ অবস্থায় কেউ সৎকার করতে রাজী নয়। প্রায়শ্চিত্ত এখন না করালে কেউ ও মড়া ছোবে না । প্রায়শ্চিত্ত করাতে পাচ-ছ টাকা নাকি খরচ । আমাদের হাতে অত তো নেই—ম বললেন । কে যেন বললে—ত এ অবস্থায় হাতে না থাকলে লোকের কাছে চেয়ে-চিন্তে আনতে হয়, কি আর করবে ? দাদাকে মা ও-পাড়ার কাছে পাঠালেন টাকার জন্তে । খানিকট পরে ওপাড়া থেকে জনকতক ঘণ্ডামত লোক এল—শুনলাম তারা গালাগালি দিতে দিতে বাড়িতে ঢুকছে—এমন ছোটলোকের পাড়াও তো কখনো দেখি নি ? কোথায় পাবে এরা যে প্রাচিত্তির করাবে ? প্রচিত্তির না হ’লে মড়া কি সারা দিনরাত ঘরেই পড়ে থাকবে ? যত ছোটলোক সব— কোনো ভয় নেই, দেখি মড় বার হয় কিনা । আমি উত্তেজনার মাথায় মড়া ছয়ে বসে থাকার কথা ভুলে গিয়ে তাড়াতাড়ি দোরের কাছে এসে দাড়ালাম। এদের মধ্যে আমি একজনকে কেবল চিনি। মাঠবাড়ির ফুটবল খেলার ময়দানে দেখেছিলাম । ওরা নিজেরাই কোথা থেকে বঁাশ কেটে নিয়ে এল-পাট নিয়ে এসে দড়ি পাকালে, তারপর বাবাকে বার করে নিয়ে গেল—দাদা গেল সঙ্গে সঙ্গে শ্মশানে। একটু পরে সন্ধ্যা হ’ল ।