পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ v®ጫ সীতা উঠে একটা কম্বল পেতে দিলে। হীরুঠাকুর বললে, “তোমার দাদা কোথায় ?” দাদার সঙ্গে ওর বড় ভাব । হীরুঠাকুরের গল্প দাদা শুনতে ভালবাসে, হীরুঠাকুরের কষ্ট দেখে দাদার দুঃখ খুব, হীরুঠাকুর না খেতে পেলে দাদা বাড়ি থেকে চাল চুরি করে দিয়ে আসে। এখানে যখন খেতে আসত তখুনি প্রথম দাদার সঙ্গে ওর আলাপ হয়, এই বারান্দায় বসেই। হীরুঠাকুরের কেউ নেই—একটা ছেলে ছিল, সে নাকি আজ অনেক দিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে । হীরু ঠাকুরের এখনও বিশ্বাস, ছেলে একদিন ফিরে আসবেই এবং অনেক টাকাকড়ি আনবে, তখন তার দুঃখ ঘুচবে। দাদা হীরুর ওই-সব গল্প মন দিয়ে বসে বসে শোনে। অমন শ্রোতা এ-গায়ে বোধ হয় হীরুঠাকুর আর কখনও পায় নি । খেতে বসে হীরুঠাকুর এক মহা গোলমাল বাধিয়ে বসল। জ্যাঠামশায়ের ছোট মেয়ে সরিকে ডেকে বললে, ( হীরু কারুর নাম মনে রাখতে পারে না ) “খুকী শোন, বাড়ির মধ্যে জিজ্ঞেস কর তো ডালের বাটিতে তারা কি কিছু মিশিয়ে দিয়েছেন ? আমার গা যেন ঘুরচে " সবাই জানে হীরুঠাকুরের মাথা খারাপ, সে ওরকম একবার আমাদের বাড়ি খেতে বসেও বলেছিল, কিন্তু বাড়িসুদ্ধ মেয়েরা বেজায় চটল এতে । চটবারই কথা । জ্যাঠাইমা বললেন— “সেজঠাকুরপোর খেয়ে-দেয়ে তো আর কাজ নেই, ও আপদ মাসের মধ্যে দশ দিন আসে এখানে থেতে। তার ওপর আবার বলে কি-না ডালে বিষ মিশিয়ে দিইচি আমরা। আমরণ মড় ইপোড়া বামুন, তোকে বিষ খাইয়ে মেরে কি তোর লাখে টাকার তালুক হাত করব ? আজ থেকে বলে দাও সেজঠাকুরপো, এ-বাড়ির দোর বন্ধ হয়ে গেল, কোনো দিন সদরের চৌকাঠ মাড়ালে বর্ণটা মেরে তাড়াবো।” হীরু তখন খাওয়া শেষ করেছিল। জ্যাঠাইমার গালাগালি শুনে মুখখান কঁচুমাচু ক’রে উঠে গেল। দাদা এসময় বাড়ি ছিল না—আমাদের মুখে এর পর শুনে বললে—আহা, ও পাগল, ছেলের শোকে পাগল হয়েছে। ও কি বলে না-বলে তা কি ধরতে আছে ? ছিঃ, খাবার সময় জ্যাঠাইমার গালমন্দ করা ভাল হয়নি । আহা ! সীতা বললে—গালাগাল দেওয়া ভাল হয় নি কেন, খুব ভাল হয়েছে। খামোক বলবে যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে ? লোকে কি মনে করবে ? দাদা আর কিছু বললে না, চুপ ক’রে রইল। সে কারুর সঙ্গে তর্ক করতে পারে না, সীতার সঙ্গে তো নয়ই। একবার কেবল আমায় জিজ্ঞেস করলে—হীরুজ্যাঠা কোন দিকে গেল রে জিতু ? আমি বললাম আমি জানিনে। এর মাস দুই-তিন পরে, মাঘ মাসের শেষ, বিকেল বেলা। আমাদের ঘরের সামনে একটুখানি পড়ন্ত রোদে পিঠ দিয়ে স্কুলের অঙ্ক কচি—এমন সময় দেখি হীরুঠাকুরকে সস্তপণে আস্তে আস্তে ধরে নিয়ে আসছে দাদা । হীরুঠাকুরের চেহারা শীর্ণ, মাথার চুল আরও উসকোখুসকো, মুখ প্যাডাস-জরে যেমনি কাপচে, তেমনি কাশচে । শুনলাম আজ নাকি চার পাচ দিন অমুখ অবস্থায় আমাদেরই পাড়ায় ভট্টাচাযিদের পূজোর দালানে শুয়ে ছিল। অমুখে কাশ-খুধু ফেলে ঘর অপরিষ্কার করে দেখে তারা এই অবস্থায় বলেছে সেখানে জায়গা হবে না। হীরুঠাকুর চলতে পারে ন, যেমন দুৰ্ব্বল, তেমনি জর আর সে কি ভয়ানক কাশি ! কোথায় যায়, তাই দাদা তাকে নিয়ে এসেছে জ্যাঠামশায়দের বাড়ি। ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গেল। দাদার কি এতটুকু বুদ্ধি দেননি ভগবান! এটা কি নিজেদের বাড়ি যে এখানে যা খুশি করা চলবে ? কোন