পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२ বিভূতি-রচনাবলী বীরুর মেজ বোন, আমার চেয়ে কিছু ছোট, দেখতে বেশ ভাল। সে ওখানে ছিল না তখন —এক এক নেপালী নাচ হয় না বলে বেশী বাহাদুরিটা আমার আর নেওয়া হয়নি সে-দিন । সীতার বই পড়ার ব্যাপার নিয়ে জ্যাঠাইমা সকল সময় সীতাকে মুখনাড়া দেন। সীতা যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফিটফাট থাকতে ভালবাসে এটাও জ্যাঠাইমা বা কাকীমারা দেখতে পারেন না। সীতা চিরকাল ওই রকম থেকে এসেছে চা-বাগানে। একটিমাত্র মেয়ে, মা তাকে সব সময় সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখতে ভালবাসতেন, কতকটা আবার গড়ে উঠেছিল মিস্ নটনের দরুন । মিস নর্টন মাকে পড়াতে এসে নিজের হাতে সীতার চুল আঁচড়ে দিত, চুলে লাল ফিতে বেঁধে দিত, হাত ও মুখ পরিষ্কার রাখতে শেখাত। এখানে এসে সীতার দুখানার বেশি তিনখান কাপড় জোটেনি কোন সময়—জামা তো নেই-ই। (জ্যাঠাইমা বলেন, মেয়েমানুষের আবার জামা গায়ে কিসের 1 ) কিন্তু ওরই মধ্যে সীতা ফরসা কাপড়খানি পরে থাকে, চুলটি টান টান করে বেঁধে পেছনে গোল খোপা বেঁধে বেড়ায়, কপালে টিপ পরে—এ গায়ের এক পাল অসভ্য অপরিস্কার ছেলেমেয়ের মধ্যে ওকে সম্পূর্ণ অন্ত রকমের দেখায়, বেকেউ দেখলেই বলতে পারে ও এ-গায়ের নয়, এ অঞ্চলের ন—ও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । দুটো জিনিস সীতা খুব ভালবাসে ছেলেবেলা থেকে—সাবান আর বই। আর এখানে এসে পৰ্য্যস্ত ঠিক ওই দুটো জিনিসই মেলে না—এ-বাড়িতে সাবান কেউ ব্যবহার করে না, কাকীমাদের বাক্সে সাবান হয়ত আছে কিন্তু সে বাক্স-সাজানো হিসাবে আছে, যেমন তাদের বাক্সে কাচের পুতুল আছে, চীনেমাটির হরিণ, থোকা পুতুল, উট আছে—তেমনি। তবুও সাবান বরং খুজলে মেলে বাড়িতে—কেউ ব্যবহার করুক আর নাই করুক—বই খুঁজলেও মেলে না—দুখান বই ছাড়া—নতুন পাজি আর সত্যনারায়ণের পুথি । আমরা তো চা-বাগানে থাকতাম, সে তো বাংলাদেশেই নয়—তবুও আমাদের বাক্সে অনেক বাংলা বই ছিল । নানারকমের ছবিওয়ালা বাংলা বই—ষীশুর গল্প, পরিত্রাণের কথা, জবের গল্প, সুবর্ণবণিকপুত্রের কাহিনী আরও কত কি । এর মধ্যে মিশনারি মেমেরা অনেক দিয়েছিল, আবার বাবাও কলকাতা থেকে ডাকে আনাতেন—সীতার জন্যে এনে দিয়েছিলেন কঙ্কাবতী, হাতেম তাই, হিতোপদেশের গল্প, আমার জন্তে একখানা ভূগোল-পরিচয় বলে বই আর একখানা ঠাকুরদাদার ঝুলি । আমি গল্পের বই পড়তে তত ভালবাসিনে, দু-তিনটে গল্প পড়ে আমার বইখানা আমি সীতাকে দিয়ে দিয়েছিলাম । আমার ভালো লাগে যীশুখৃষ্টের কথা পড়তে। পৰ্ব্বতে যীশুর উপদেশ, যীশুর পুনরুখান, অপব্যয়ী পুত্রের প্রত্যাবৰ্ত্তন। এ সব আমার বেশ লাগে। এখানে ও সব বই পাওয়া যায় না বলে পড়িনে। যীশুর কথা এখানে কেউ বলেও না । একখানা খৃষ্টের রঙীন ছবি আমার কাছে আছে—মিস নর্টন দিয়েছিল—সেখানা আমার বড় প্রিয়। মাঝে মাঝে বার ক’রে দেখি ॥ ২ হিন্দু দেবতার কোন মূৰ্ত্তি আমি দেখিনি, জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে যা পূজো করেন, তা গোলমত পাথরের ছড়ি । এ-গ্রামে দুর্গাপূজা হয় না, ছবিতে দুর্গামূৰ্ত্তি দেখেছি, ভাল বুঝতে পারিনে, কিন্তু একটা ব্যাপার হয়েছে এর মধ্যে। চৌধুরীপাড়ায় বড় পুকুরের ধারের পাকুড়গাছের তলায় কালে পাথরের একটা দেবমূৰ্ত্তি গাছের গুড়িতে ঠেসানো আছে—আমি একদিন দুপুরে পাকুড়তলা দিয়ে যাচ্ছি, বাবা তখন বেঁচে আছেন কিন্তু তার খুব অমুখ-ওই সময় মূৰ্ত্তিটা আমি প্রথম দেখি—জায়গাটা নির্জন, পাকুড়গাছের ডালপালার পিছনে অনেকখানি নীল আকাশ,