পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8b- বিভূতি-রচনাবলী অসময় নেই, রাত নেই দিন নেই। এই তো সেদিন বসে আছি জ্যাঠাইমাদের পুকুরধারের বাগানে একলাটি—হঠাৎ দেখি পুকুরপাড়ের আমগাছগুলোর ওপরকার নীল আকাশে একটা মন্দিরের চূড়ো—প্রকাও মন্দির, রোদ লেগে ঝকমক্‌ করচে—সোনা না কি দিয়ে বাধানো যেন। মন্দিরের চারিপাশে বাগান, চমৎকার গাছপাল, ফুল ফুটে আছে, অপূৰ্ব্ব দেখতে—ঠিক যেন আমাদের সোনাদা চা-বাগানের ধারে বনের গাছের ডালে ডালে ফোটা নীল আর্কিডের ফুল ! আর একদিন দেখেছিলাম ঠিক ওই জায়গায় বসেই আকাশ বেয়ে সন্ধ্যার সময় তিনটি সুন্দরী মেয়ে, পরনে যেন শ্বেতচমরীর লোমে বোন সাদা চকচকে লুটিয়ে-পড়া কাপড়—তারা উড়ে যাচ্ছে এক সারিতে, বোধ হয় পুরো পাচ মিনিট ধরে তাদের দেখেচি। তারপর রোদ চক্চক্‌ করতে লাগল, আর তাদের স্পষ্ট দেখা গেল না—ওপরের দিকে যেতে যেতে মিলিয়ে গেল । এরকম নতুন নয়, কতবার দেখেচি, প্রায়ই দেখি, দু-পাচদিন অন্তর দেখি, দেখে দেখে আমার সয়ে গিয়েচে, আগের মত ভয় হয় ন} । কিন্তু এক-একবার ভাবি, এ আমার এক রকম রোগ— না চোখ খারাপ হয়ে গিয়েচে, না কি ? আমার কারুর সঙ্গে মিশতে সাহস হয় না এইজন্যে যে, হয়ত কোন সময় আবার অন্ত ভাব এসে যাবে, আর কে সঙ্গে থাকবে সে আমায় ভাববে পাগল। হয়ত হাসবে, হয়ত লোককে ব’লে দেবে। এমনিও এ-বাড়িতে জ্যাঠাইমা, কাকীমা, কাকা, এরা আমায় পাগলই ভাবেন । কি করবে। আমি যা দেখি, ওঁরা তা দেখতে পান না, এই আমার অপরাধ। একটা উদাহরণ দিই— ফাল্গুন মাসে ছোটকাকার মেয়ে পানী অমুখে পড়ল। একদিন দু'দিন গেল, অমুখ আর সারে না। জর লেগেই আছে। সাতদিন কেটে গেল—জর একই ভাব । দশ দিনের দিন অসুখ এমনি বাড়ল, নৈহাটি থেকে বড় ডাক্তার আনবার কথা হ’ল। পানীকে আমার এ-বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাল লাগে । তার বয়স বছর সাত-আট, বাঁকড়া চুল মাথায়, চোখ কটা, সাহেবদের ছেলেমেয়েদের মত। এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের মুথে যেমন খারাপ কথা আর গালাগালি লেগেই আছে—পানীর কিন্তু তা নয়। তার একটা কারণ, সে এতদিন মামার বাড়িতে তার দিদিমার কাছে ছিল, গঙ্গার ওপারে ভদ্ৰেশ্বরে । সে বেশ মেয়ে, বেশ গান করতে পারে, প্রাণে তার দয়ামায়া আছে । পানীর অমুখ হয়ে পৰ্য্যন্ত আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল—আমার ইচ্ছে হয়েছিল ওর কাছে গিয়ে বসে গায়ে হাত বুলিয়ে দিই—কিন্তু কাকীমা তো আমায় বিছানা ছুতে দেবে না, সেই ভয়ে পারতাম না। পানীর তখন সতেরো দিন জর চলছে—বুড়ে গোবিন্দ ডাক্তার ঘোড়ার গাড়ি ক'রে স্টেশন থেকে এল—দালানে বসে মশলার কৌটো বের করে মশলা খেলে, ভাজা মশলার গন্ধে দালান ভুর ভূর করতে লাগল-চা করে দেওয়া হ'ল, চ খেলে, তার পর ওষুধ লিখে দিয়ে ভিজিটের টাকা মেজকাকার হাত থেকে নিয়ে না দেখেই পকেটে পুরলে—তার পর রোগীকে বার বার গরম জল খাওয়ানোর কথা বলে গাড়ি ক'রে চলে গেল । একটু একটু অন্ধকার হয়েচে কিন্তু এখনও বাড়িতে সন্ধ্যার শাখ বাজেনি, কি আলো জালা হয়নি—হয়ত ডাক্তার আসবার জন্তে সকলে ব্যস্ত ছিল বলেই । আমি রোগীর ঘরে দোরের কাছে গিয়ে দাড়ালাম, কিন্তু পানীর বিছানায়—পানীর শিয়রে যে বসে আছে তাকে চিনতে পারলাম না। লালপাড় শাড়ী পরনে আধঘোমটা দেওয়া কে একজন, জ্যাঠাইমার মত দেখতে বটে কিন্তু জ্যাঠাইমা তো নয় । ঘরের মধ্যে আর কেউ নেই—এইমাত্র কাকীমা বাইরে গেছেন ডাক্তারে কি বলে গেল তাই জানতে ছোটকাকার কাছে। আমি ভাবচি লোকটা কে, এমন