পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6 8 বিভূতি-রচনাবলী মায়ের একটু বেশী মাত্র । এতেই আমার সন্দেহ হ’ল বোধ হয় আমার মধ্যেই কোনো দোষ আছে, যার ফলে আমি এদের শিক্ষা নিতে পারচি নে। ভাবলাম আমার যে ভাল লাগে না, সে বোধ হয় আমি বুঝতে পারি না বলেই—হয়ত চা-বাগানে থাকার দরুন ওদের ধৰ্ম্ম আমরা শেখবার সুযোগ পাইনি, যে আবহাওয়ার মধ্যে ছেলেবেলা থেকে মানুষ হয়েচি, সেটাই এখন ভাল লাগে । ম্যাটিক পাস ক’রে শ্রীরামপুর কলেজে ভৰ্ত্তি হলাম । জ্যাঠামশায়দের গ্রাম আটঘরার নবীন চৌধুরী—যার বড় ছেলে ননী ভাল ফুটবল খেলতে পারে এবং যে প্রায়শ্চিত্তের বাধা-বিঘ্ন না মেনে বাবার সৎকারের সময়ে দলবল জুটিয়ে এনেছিল—তারই ভগ্নীপতির বাড়ি অর্থাৎ নবীন চৌধুরীর বড় মেয়ে শৈলবালার শ্বশুরবাড়ি শ্রীরামপুরে। ননীর যোগাড়যন্ত্রে তাদের শ্বশুরবাড়িতে আমার থাকবার ব্যবস্থা হ’ল । এসে দেখি এদেরও বেশ বড় সংসার, অনেক লোক। শৈলদিদির স্বামীরা ছ'ভাই, তার মধ্যে চার ভাইয়ের বিয়ে হয়েচে, আর একটি আমার বয়েসী, ফাস্ট ইয়ারেই ভক্তি হ’ল আমার সঙ্গে । সকলের ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। শৈলদি বাড়ির বড়বে, আমি তার দেশের লোক, সবাই আমাকে খুব তাদর্যত্ন করলে। এখানে কিছুদিন থাকবার পরে বুঝলাম যে, সংসারে সবাই জ্যাঠামশায়দের বাড়ির ছাচে গড় নয় । চা-বাগান থেকে এসে বাংলা দেশ সম্বন্ধে যে একটা হীন ধারণ আমার হয়েছিল, সেটা এখানে দু-চার মাস থাকতে থাকতে চলে গেল । আর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে এ বাড়ির মেয়ের কেউ কারও বড় একটা অধীন নয় । কোন একজনকে সকলের ভয় ক’রে চলতে হয় না বা কোন একজনের কথায় সকলকে উঠতে বসতে হয় না । আমি থাকি বাইরের একটা ঘরে, কিন্তু অল্পদিনেই আমি বাড়ির ছেলে হয়ে পড়লাম। শৈলদিদি খুব ভাল, আমাকে ভাইয়ের মত দেখে । কিন্তু এতবড় সংসারের কাজকৰ্ম্ম নিয়ে সে বড় ব্যস্ত থাকে—সব সময় দেখাশুনো করতে পারে না । শৈলদিদির বয়স আমার মেজকাকীমার চেয়ে কিছু ছোট হবে—তিন-চারটি ছেলেমেয়ের মা । আটঘরায় থাকতে খুব বেশী আলাপ ছিল না, দু-একবার জ্যাঠামশায়দের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে আলাপ করে এসেছিল, তারপর ননী কথাটা পাড়তেই তখনি রাজী হয়ে যায় আমায় এখানে রাখবার সম্বন্ধে । শৈলদিদির স্বামী তার কোনো কথা ফেলতে পারে না । বাড়ির সকলের সঙ্গে খুব আলাপ হয়ে গেল । বাড়ির মধ্যে সৰ্ব্বত্র যাই—জ্যাঠামশায়দের বাড়ির মত এটা ছুয়ো না, ওটা ছুয়ো না—কেউ করে না। সব ঘরে যাই, সব বিছানাতেই বসি—সবাই আদর্যত্ব করে, পছন্দ করে। এখন বয়স হয়েচে বুঝতে পেরেচি, আটঘরায় যতটা বাধাবাধি, এসব শহর-বাজারে অত নেই এদের । কষ্ট হয় মার জন্তে, সীতার জন্যে— তারা এখনও জ্যাঠাইমার কঠিন শাসনের বাধনে আবদ্ধ হয়ে ক্রীতদাসীর মত উদয়াস্ত খাটচে । দাদার জন্তেও কষ্ট হয়। সে লেখাপড়া শিখলে না—চাকুরি করবে সংসারের দুঃখ ঘুচোবে বলে –কিন্তু চাকুরি পায় না, ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, আজ বারে টাকা মাইনের চাকুরি করে, কাল জবাব হয়ে যায়, আবার আর এক জায়গায় ষোল টাকা মাইনের চাকুরি জোটায় । এত সামান্ত মাইনেতে বিদেশে থেয়ে পরে কোন মাসে পাঁচ টাকা, কোন মাসে তিন টাকার বেশী মাকে পাঠাতে পারে না, তাতে কি দুঃখ ঘুচবে ? অথচ না শিখলে লেখাপড়, না করতে পারলে কিছু | কলেজের ছুটির পরে গঙ্গার ধারে একখানা বেঞ্চির ওপর বসে এই সব কথাই ভাবছিলাম।