পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

e বিভূতি-রচনাবলী দিয়ে সাদা বার-কর, চোথে চশমা—প্রায়ই পরনে সাহেবী পোশাক থাকে। বাঙালী পোশাক পরলে পরেন হাত-গিলে-করা মিহি আদির পাঞ্জাবি ও কোচানো কাচি ধুতি, পারে কালো এ্যালবার্ট জুতো । - কৰ্ত্ত নীলাম্বর রায়কে আমি বেশী দেখিনি। তিনি তার তাকিয়া বালিশ, গড়গড়, পিকদাণী নিয়ে দোতলাতে থাকেন। কালেভদ্রে তার কাছে আমার যাওয়া দরকার হয়। বড় ছেলে অজয়বাবুই কাজকৰ্ম্ম দেখাশুনা করেন—তার সঙ্গেই আমার পরিচয় বেশী । অজয়বাবু লোক মনা নন–কিন্তু নবীনবাবু ও অমরনাথের মুখে প্রথম দিনেই একটা উগ্র দাম্ভিকতার ছাপ লক্ষ্য করলুম। আমি এ ধরনের লোকের সংস্পর্শে জীবনে এ পর্য্যন্ত আসি নি—কি জানি আমার কোন ব্যবহারে এরা কি দোষ ধ'রে ফেলেন—সেই চিন্তা আমায় সৰ্ব্বদা সন্ত্রস্ত করে তুললে । ওদের বাড়ি হরি ঘোষের স্ট্রীটে ; বাড়িটার পূর্ব দিকে একটা ছোট গলি—কিন্তু সেই দিকেই বাড়ির সদর । হরি ঘোষের স্ট্রীটের দিকটা রেলিং-বসানো লম্বা বারান্দা—বারান্দায় উঠবার সিড়ি নেই সেদিকে। রাস্তার ওপরের ছোট ঘরটাতেই আমার থাকবার জায়গা নির্দিষ্ট হ'ল । এই ঘরে আমি যে একলা থাকি তা নয়, পাশাপাশি নীচু চার-পাচটা তক্তাপোশের ওপর ঢাল্লা ফরাস পাত, তার ওপরে রাত্রে যে কত লোক শোয় তার হিসেব রাখা শক্ত ; এদের দেশের কাছারীর নায়েব কুঞ্জ বসু প্রায়ই আসে কলকাতায়, সে আমার পাশেই বিছানা পাতে, তার সঙ্গে একজন মুহুরী আসে, সে নায়েবের পাশে শোয়। বাড়ির দুজন চাকর শোয় ওদিকটাতে। ওস্তাদজী বলে একজন গানের মাস্টার বাড়ির ছেলেমেয়েদের গান ও হারমোনিয়ম বাজাতে শেখায়—সে আর তার একজন ভাইপো শোয় চাকরদের ও আমাদের মধ্যে। এতগুলো অপরিচিত লোকের সঙ্গে একসঙ্গে শোয়া কখনো আভোস নেই—প্রথম দিনেই এদের গল্পগুজব, হাসি-কাশি, তামাকের ধোয় আমাকে অতিষ্ঠ ক'রে তুললে। সীতার মুখ মনে ক’রে সব অসুবিধাকে সহ করবার জন্তে প্রস্তুত হই । একদিন আমি সেরেস্তা-ঘরে বসে কাজ করচি–হঠাৎ দেখি মেজবাবু ঘরে ঢুকেচেন । আমি মেজবাবুকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাড়ালাম। মেজবাবু চারদিকের দেওয়ালের দিকে চোখ তুলে চেয়ে বললেন—এ ঘরের এই ছবিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্চে, তুমি নজর রাখো না ? মেজবাবুর সামনাসামনি হওয়া এই আমার প্রথম। আমাকে ‘তুমি' বলে সম্বোধন করতে আমি মনে আঘাত পেলাম এবং আমার ভয়ও হ’ল । তা ছাড়া ছবি নষ্ট হওয়ার কৈফিয়ত আমি কি দেবো বুঝতে না পেরে চুপ করে আছি, এমন সময় মেজবাবু বাজখাই আওয়াজে ডাকলেন— দৈতারী— দৈতার সেরেস্তার কালির বোতল গুনে গুনে আলমারিতে তুলছিল পাশের ঘরে, সে ঘরের পাশে বারানায় এসে দাড়িয়ে বললে—হুজুর— —এই উল্লুক, তুমি দেখতে পাও না ঘরের ছবিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ? দৈতার ঘরের দেওয়ালের দিকে বিপন্ন মুখে চেয়ে দাড়িয়ে রইল । মেজবাবু হঠাৎ আমার ডেস্ক থেকে রুলটা তুলে নিয়ে তাকে হাতে পিঠে ঘা-কতক বসিয়ে দিয়ে বললেন—ষ্ট্ৰপিড পাজি, বসে বসে শুধু মাইনে খাবে ? এক ডজন চাকর বাড়িতে মাইনে দিয়ে রাখা হয়েচে শুধু ফাকি দেবার জন্তে ? পাড়ো ছবিগুলো এক-একথান করে—পাড়ে আমার সামনে— দৈতারীর সে রুলের ঘা যেন আমার পিঠেই পড়ল। আমি ভরে ভয়ে দৈতারীকে ছবি পাড়তে সাহায্য করতে লাগলুম। আমি সামান্ত মাইনের চাকুরি করি—মেজবাৰু আমাকেও