পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড).djvu/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

[ リ・] ইছামতী তীরের পঞ্জীপ্ৰকৃতি তাকে মুগ্ধ করেছিল বলেই বোধ হয়। সেখানের মানুষগুলোকে তিনি ভালবেসেছিলেন । তবে সবাইকে সমান নয়।--তথাকথিত ব্রাত্য পতিত যারা, সমাজের নিচুস্তরের হতদরিদ্র মানুষগুলিষ্ট ণ্ঠর সমধিক প্রিয় ছিল। পল্লীগ্রামের লোক মাত্রেই সরল —এমন ভ্রান্ত ধারণা উঠার থাকবার কথা নয়, ছিল ও না । অলস, খণ্ডাংশে-পরিণত-সামান্থপৈতৃক-সম্পত্তির-আয়-সম্বলি উচ্চবর্ণের বা মধ্যবিত্ত লোকদের ভণ্ডামি, চরিত্রদোষ, কৰ্মবিমুখত, মিথ্যাচার, সর্বোপরি অকারণ ও অপরিমাণ পরীশ্ৰীকাতরতা তার চোখ এড়ায় নি। তাদের যথাযথ ভাবেই অঙ্কিত করেছেন । তবে এদের সম্বন্ধেও তেঁর মনে কোন তিক্তিতা ছিল না । বরং ভালবাসাই ছিল। সবাইকেই ভালবাসতেন-রকম আর বেশী । ভালবাসতেন বলেই কোথাও অতিরিক্ত বর্ণপ্রয়োগ করেন। নি, যেমনটি ঠিক তেমনিভাবেই দেখেছেন, দেখিয়েছেন। অতিভাষণ বা অতিরঞ্জন ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। Emphasis প্রয়োগ-বাংলা সাহিত্যে যেটা তারাশঙ্কর থেকে শুরু হয়েছে (তারাশঙ্কর যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকুই দিতেন—এখন সে মাত্রাজ্ঞানের অভাব হয়ে পড়েছে) --বর্তমান বাংলা কথাসাহিত্যে যা প্ৰধান লক্ষণীয়-বিভূতিভূষণের মধ্যে তা একেবারেই ছিল না। তার তুলি জাপানী চিত্রকরদের মতোই লঘু বর্ণপ্রয়োগ ক’রে গেছে।-অনেকে সেজন্যে তাকে তখন ঈষৎ করুণার চােখে দেখতেন। সৌভাগ্যের কথা—এ অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্য, সুমহৎ স্রষ্টার সুন্ম কারুকলা-বাঙালী পাঠকসাধারণের চোখ এড়ায় নি, তারা তঁর যথার্থ মূল্যই দিয়েছে। সেইজন্তে, মানুষ যেমন হয়, দোসগুণে মিলিয়েই তাদের একেছেন তিনি-কোথাও দোষের ওপর জোর দেন নি । বরং, সাধারণ ভাবে মানুষকে ভালবাসতেন বলেই যেন দোষের মধ্যে থেকে গুণও কিছু খুঁজে বার করেছেন। এদিক দিয়ে তিনি ডিকিনস ও শরৎচন্দ্রের সগোত্র। তবে সমান বলছি না । আমার পক্ষে প্লষ্টতা প্ৰকাশ হচ্ছে কিনা " ..নি না-অামার ধারণা কোন কোন ক্ষেত্রে বিভূতিভূষণ মহত্তর শিল্পী । এ উপন্যাসে কাদের কথা লিখবেন তা পূর্বাহ্নেই বলেছেন-ইছামতীর প্রাকৃকথনে : “সবুজ চরাভূমির তৃণক্ষেত্রে ধখন স্বমুখ জ্যোৎস্নায়ান্ত্রির জোৎস্না পড়বে, গ্রীষ্মদিনে সাদা খোকা থোকা আকন্দকুল ফুটে থাকবে, সেঁন্দালি ফুলের ঝাড় দুলবে নিকটবর্তী বনঝোপ থেকে নদীর মৃদু বাতাসে, তখন নদীপথযাত্রীরা দেখতে পাবে নদীর ধরে পুরনো পোড়ো ভিটের ঈষদুষ্কচ পোতা, বর্তমানে হয়ত আকন্দ ঝোপে ঢেলে ফেলেছে তাদের বেশি শ্বংশটা । হয়ত দুএকটা উইয়ের ঢিবি গজিয়েছে কোনো কোনো ভিটের পোতায়। এই সব ভিটে দেখে তুমি স্বপ্ন দেখবে অতীত দিনগুলিয়, স্বপ্ন দেখবে সেই সব মা ও ছেলের, ভাই ও বোনের- যাদের জীবন ছিল একদিন এইসব বাস্তু ভিটের সঙ্গে জড়িয়ে। কত সুখদুঃখের অলিখিত ইতিহাস বর্ষাকালে জলধারাঞ্চিত ক্ষীণরেখার মতো আঁকা হয় শতাব্দীতে শতাব্দীতে এদের বুকে । সুৰ্য আলো দেয়, হেসুস্থর আকাশ শিশির বর্ষণ করে, জ্যোৎস্না-পক্ষের টাঙ্গ জোৎস্না ঢালে এদের বুকে।--