পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩১২ বিভূতি-রচনাবলী রাতে রাঘবের চোখে এতটুকু ঘুম আসিল না—পলকের নিমিত্ত রাঘব পাগলের মত হইলেন —যে যাহা বলিল তাঁহাই করিয়া দেখিলেন। ডাব খাইয়া ও পুকুরের পচা পাক মাথায় দিনরাত দিয়া থাকিতে থাকিতে নিউমোনিয়া হইবার উপক্রম হইল। অবশেষে বঁাশবেড়ের মনোহর ডাক্তারের ঔষধ ব্যবহার করিয়া দেখিলেন । কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আরও দিন ছয় সাত কাটিয়া গেল। রাঘব সন্ধ্যার পরই হাত-পা ধুইয়া মন স্থির করিয়া শুইতে যান। কিন্তু বালিশে মাথা দিয়াই বুকের মধ্যে গুরু গুরু করে—আজও বোধহয় ঘুম. বাকীটা আর রাঘব ভাবিতে পারেন না । রাজমিস্ত্রীর দল কাজ শেষ না করিয়াই চলিয়া গেল। উঠানে জঙ্গল বাধিয়া উঠিল । রাঘব স্নানাহার করিতে চান না, চলাফেরা করিতে চান না, সব সময়েই ঘরের দাওয়ায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকেন। তামাক খাইবার রুচিও ক্রমে হারাইয়া ফেলিলেন। লোকজনের সঙ্গে ভাল করিয়া কথাবার্তা কহিতে ভালবাসেন না, পয়সার ভীড় উপুড় করিয়া গণিয়া দেখিবার স্পৃহাও চলিয়া গেল। চিকিৎসা তখনও চলিতেছিল। গ্রামের বুদ্ধ শিব কবিরাজ বলিলেন—তোমার রোগট হয়েছে মানসিক । ঘুম হবে না এ-কথা ভাবে কেন শোবাব আগে ? খুব সাহস করবে, মনে মনে জোর করে ভাববে—আজ ঘুম হবে, নিশ্চয়ই হবে, আজ ঠিক ঘুমুবো—এ রকম করে দ্যাথো দিকি ? আর সকাল সকাল শুতে যেও নী—যে সময় যেতে, সেই সময় যাবে। কবিরাজের পরামর্শ মত রাঘব সন্ধ্যার পর পুরানো দিনের মত রন্ধন করিয়া আহার করিলেন। দাওয়ায় বসিয়া গুনগুন করিয়া গানও গাছিলেন। তারপর ঠাণ্ড জলে হাত-পা ও মাথা ধুইয়া শয়ন করিতে গেলেন। মনে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প করিলেন—আজ তিনি নিশ্চয়ই ঘুমাইবেন–নিশ্চয়ই—নিশ্চয়ই। কিন্তু বালিশে মাথা দিয়াই বুকটা কেমন যেন করিয়া উঠিল! ঘুম যদি না হয় ?. পরক্ষণেই মন হইতে সে-কথা ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিলেন–নিশ্চয়ই ঘুম হইবে। পাশ ফিরিয়া পাশ-বালিশটা আঁকড়াইয়া শুইলেন। ঘরের দেওয়ালের একখানা বাধানো রাধাকৃষ্ণের ছবি বাতাস লাগিয়া ঠকৃঠক্‌ শব্দ করিতেছে দেখিয়া আবার বিছানা হইতে উঠিয়া সেখানা নামাইয়া রাখিলেন। পুনরায় শুইয়া পড়িয়া জোর করিয়া চোখ বুজিরা রছিলেন। আধঘণ্টা.এক ঘণ্টা--এইবার তিনি নিশ্চয়ই ঘুমাইবেন...বুকের মধ্যে গুরুগুত্ব করিতেছে কেন?..না, এইবার ঘুমাইবেনই। দুই ঘণ্টা—তিন ঘণ্টা।--রাত একট, গ্রাম নিযুতি, কোনো দিকে সাড়াশব্দ নাই— কাওয়া-পাড়ায় এক আধটা কুকুরের ঘেউঘেউ ছাড়া । না-রাত বেশী হইয়াছে, আর রাঘব জাগিয়া থাকিবেন না, এইবার ঘুমাইবেন। বদিকে শুইয়া সুবিধা হইতেছে না, হাতখান বেকায়দায় কেমন যেন মুচড়াইয়া আছে, ডানদিক ফিরিয়া শুইবেন। ছারপোকা ?..না, ছারপোকা তো বিছানায় নাই ?...যাহা হউক