পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

98 বিভূতি-রচনাবলী রাঘব চক্রবর্তী একবার চারিদিকে চাহিয়াই কাছে আসিয়া ভাগিনেয়-বধূর পা জড়াইয়া ধরিয়া কাদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন—ম! তুমি মানুষ নও, তুমি কোনো ঠাকুর-দেবতা হবে। ছেলে বলে আমায় মাপ করে । তারপর পুটুলি খুলিয়া সব গহনাগুলি ভাগিনেয়-বন্ধুর হাতে প্রত্যপণ করিলেন, কিন্তু বাসায় থাকিতে রাজি হইলেন না । —নালালের কাছে কিছু নলবার মুখ নেই আমার। তুমি মা—তোমার কাছে বলতে লজ্জা নেই, বুঝলে না ? কিন্তু তার কাছে... & ইহার মাস পাঁচ ছয় পরে রাঘব চক্রবর্তীর গুরুতর অমুখের সংবাদ পাইয়া নন্দলাল সঙ্গীক গরুর গাড়ি করিয়া তাহাকে দেখিতে গেল। ইহারা যাইবার দিন সাতেক পরে রাঘবের মৃত্যু হইল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাহার যাহা কিছু জমিজমা সব উইল করিয়া ভাগিনেয়-বধূকে দিয়৷ গেলেন। কিছু পোতা টাকার সন্ধানও দিয়া গেলেন। নন্দলালের স্ত্রীকে কাছে বসাইয়া নিজের স্বপ্নবৃত্তান্ত বলিয়া গেলেন। বলিলেন—এই যে দেখছে ঘর, এই যে বাশের খুঁটি, এর মধ্যে দেবতা আছেন মা। বিশ্বাস করে আমার কথা... ভাগিনেয়-বধু শিহরিয়া উঠিল। সেই ঘর, সেই বাঁশের খুঁটি . রাঘবের মৃত্যুর পরে ষোলো-সতেরো বৎসর নন্দলাল মামার ভিটাতে সংসার পাতাইয়া বাস করিয়াছিল। বন্ধুটি ছেলেমেয়েদের মা হইয়া সচ্ছল ঘরকার গৃহিণীপনা করিতে করিতে প্রথম জীবনের দুঃখকষ্টের কথা ভুলিয়া গিয়াছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে খুঁটি দেবতার কথাও ভুলিয়াছিল। হয়তো দুঃখের মধ্য দিয়া যে আন্তরিকতাপূর্ণ আবেগকে জীবনে একবার মাত্র লাভ করিয়াছিল, আর কখনও জীবন-পথে তাহার সন্ধান মেলে নাই।. বছর সতেরে পরে নন্দলালের স্ত্রী মারা গেল । ননালালের বড় ছেলের তখন বিবাহ হইয়াছে ও বধূ ঘরে আসিয়াছে। বিবাহের বৎসর চারেকের মধ্যে এই বউটি দুরন্ত ক্যান্সার রোগে আক্রাস্ত হইয়া পড়িল। ক্যান্সার হইল জিহায়, ক্ষত ক্রমে গভীর হইতে লাগিল— কত রকম চিকিৎসা করা হইল, কিছুতে উপকার দেখা গেল না। সে শুইয়া শুইয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিত, ইদানীং কথা পর্যন্ত কহিতে পারিত না । তাহার যন্ত্রণা দেখিয়া সকলে তাহার মৃত্যু কামনা করিত। কিন্তু বছর কাটিয়া গেল—মৃত্যুর কোনো লক্ষণ নাই, অথচ নিজে যন্ত্রণ পাইয়া, আরও পাচজনকে যন্ত্রণ দিয়া সে জীবন্মত অবস্থায় বাচিয়া রইল। বউটি শাশুড়ীর কাছে খুটি-দেবতার গল্প শোনেও নাই, জনিতও না। একদিন সে সারারাত রোগের যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছিল। শ্রাবণ মাস । শেষরাতের দিকে ভয়ানক বৃষ্টি নামিল, ঠাণ্ডাও খুৰ, বহিরে জোর বাতাসও বহিতেছিল। মাথার শিয়রে একটা কাসার ছোট ঘটিতে জল ছিল, এক চুমুক জল খাইয়। সে পাশ ফিরিয়া শুইতেই একটু অস্ত্র মত আসিল । তাহার মনে হইল, পাশের খুঁটিটা আর খুঁটি নাই। তাঁহাদের গ্রামে খামরায়ের মন্দিরের