পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অপরাজিত ૨(t সন্ধ্যার পর সে কুণ্ডুদের বাড়ি মনসার ভাসান শুনিতে গেল। অধিকারী নিজে বেহুল সাজিয়া পায়ে ঘুঙুর বাধিয়া নাচে-বেশ গানের গলা। খানিকটা শুনিয়া তাহার ভাল লাগিল না। শুধু ছড়া কাটা ও নাচ সে পছন্দ করে না,—যুদ্ধ নাই, তলোয়ার-খেলা নাই, যেন পান্‌সে-পানসে। তবুও আজিকার রাতটি বড় ভাল লাগিল তাহার। এই মনসা ভাসানোর আসর, এই নতুন জায়গা, এই অচেনা গ্রাম্য বালকের দল, ফিরিবার পথে তাহদের পাড়ার বাকে প্রস্ফুটিত হেনী ফুলের গন্ধ-ভরা নৈশ বাতাস জোনাকি-জলা অন্ধকারে কেমন মায়াময় মনে হয়।. রাত্রে সে আরও দু-একটা জিনিস সঙ্গে লইল। বাবার হাতের লেখা একখানা গানের খাতা, বাবার উদ্ভট শ্লোকের খাতাখানা বড় পেটরাট হইতে বাহির করিয়া রাখিল—বড় বড় গোটা গোট ছাদের হাতের লেখাট বাবার কথা মনে আনিয়া দেয়। গানগুলির সঙ্গে বাবার গলার স্বর এমন ভাবে জড়াইয়া আছে যে, সেগুলি পড়িয়া গেলেই বাবার সুর কানে বাজে । নিশ্চিন্দিপুরের কত ক্রীড়াব্লান্ত শান্ত সন্ধ্যা, মেঘমেদুর বর্ষামধ্যাহ্ন, কত জ্যোৎস্না-ভরা রহস্যময়ী রাত্রি বিদেশ-বিভূই-এর সেই দুঃখ-মাখানে দিনগুলির সঙ্গে এই গানের মুর যেন জড়াইয়া আছে—সেই দশাশ্বমেধ ঘাটের রাণা, কাশীর পরিচিত সেই বাঙাল কথকঠাকুর। সর্বজয়ার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, হয়ত ছেলে শেষ পর্যন্ত বিদেশে যাইবার মত করিবে না। কিন্তু তাহার অপু যে পিছনের দিকে ফিরিয়াও চাহিতেছে না। সে যে এত খাটিয়া, একে-ওকে বলিয়া কহিয়া তাহার সাধ্যমত যতটা কুলার, ছেলের ভবিষ্যৎ জীবনের অবলম্বন একটা খাড়া করিয়া দিয়াছিল—ছেলে তাহ পায়ে দলিয়া যাইতেছে—কি জানি কিসের টানে! কোথায় ? তাহার স্নেহদুর্বল দৃষ্টি তাঁহাকে দেখিতে দিতেছিল না যে, ছেলের ডাক আসিয়াছে বাহিরের জগৎ হইতে । সে জগৎট তাহার দাবী আদায় করিতে তো ছাড়িবে না—সাধ্য কি সর্বজয়ার যে চিরকাল ছেলেকে আঁচলে লুকাইয়া রাখে ? যাত্রার পূর্বে মাঙ্গলিক অম্বষ্ঠানের দধির ফোটা অপুর কপালে পরাইয়া দিতে দিতে বলিল —বাড়ি আবার শীগগির শীগগির আসব কিন্তু, তোদের ইতুপূজোর ছুটি দেবে তো ? —ই্য, ইস্কুলে বুঝি ইতুপুজোর ছুটি হয় ? তাতে আবার বড় ইস্কুল। সেই আবার আসবো গরমের ছুটিতে । ছেলের অকল্যাণের আশঙ্কায় উচ্ছ্বলিত চোখের জল বহু কষ্টে সর্বজয় চাপিয়া রাখিল। অপু মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া ভারী বোঁচকাটা পিঠে ঝুলাইয়া লইয়া বাড়ির বাহির হইয়া গেল । মাঘ মাসের সকাল। কাল একটু একটু মেঘ ছিল, আজ মেঘ-ভাঙা রাঙা রোদ কুণ্ডুবাড়ির দো-ফলা আম গাছের মার্থীয় ঝলমল করিতেছে—বাড়ির সামনে বাশবনের তলায় চক্চকে সবুজ পাতার আড়ালে বুনোমাদার রঙীন ফুল যেন দূর ভবিষ্যতের রঙীন স্বপ্নের মত সকালের বুকে।