পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জুলুল্যাণ্ডের বহু আরণ্য অঞ্চলে আজ-ও প্রচলিত। বাস্তব ইতিহাস ভূগোলের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা করে, কাল্পনিক ঘটনা দিয়েই বিশ্বের শিশু-সাহিত্যের বহু ভালো ভালো রোমাঞ্চ কাহিনী তৈরি হয়েছে। এর দরকারও আছে । মনে পড়ে প্রায় চল্লিশ বছর আগে, এম-এ পাস করেই এক বছর ধরে শান্তিনিকেতনে ইংরিজি সাহিত্য পড়িয়েছিলাম। এক দিন বারো তেরো বছরের ছেলে-মেয়েদের ক্লাস নিতে গিয়ে দেখি একটা রোগা ছেলে আমার দিকে প্রায় পিঠ ফিরিয়ে, গাছে ঠেস দিয়ে বসে কি একটা রংচঙে বই গিলছে । ক্লাসে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে দিকে ভ্ৰক্ষেপও নেই। বেজীয় চটে গিয়ে তার কাছ থেকে বইটা নিলাম। পাতলা কাগজের মলাট দেওয়া চটি এক বাংলা বই, নাম তার "তিব্বতী গুহায় ভয়ঙ্কর’ । মলাটের রংচঙে ছবিতে দেখি ভীষণ অন্ধকার গুহা থেকে একটা বিকট দানবের মুখ বেরিয়ে আছে। তার নিচে লেখা 'রোমাঞ্চ সিরিজ ২২ নং অমনি আমার বিরক্তি দূর হয়ে গেছিল। আমি জানতাম এ-জিনিসের জন্যেও ঐ বয়সে একটা খিদে থাকে। তাই ভালো বই না পেলে শেষটা বাজে বই পড়তে হয় । সে-সময়ে ইংরিজিতে বহু দুঃসাহসিক কাহিনী পাওয়া যেত, কিন্তু ঐ হতভাগ্য ছেলের সম্ভবতঃ এতটা বিদ্যা ছিল না যে ইংরেজি বইয়ের রস গ্রহণ করতে পারে । ‘টাদের পাহাড় হয়তো এই ঘটনার তিন চার বছরের মধ্যেই লেখা হয়েছিল, যদিও আমি আরো পরে সিগনেট প্রেসে প্রকাশিত সংস্করণ পড়েছিলাম । এবং ঐ ছেলের কথা মনে করে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম। আসলে শুধু প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম ও মামুলী ঘটনা, অর্থাৎ শুধু কাজের জিনিস মনে রঙ ধরায় না ; তাই দিয়ে শিশু সাহিত্য রচনা করতে হলে তার মধ্যে গ্রস্থ কারের মনের রঙ ঢালতে হয়। শুধু রূপ থাকলেই তো আর হল না, তাকে দেখার চোখও তৈরি হওয়া চাই । সেই রূপকে সব সময় পৃথিবীতে বাস্তব আকৃতি নিয়ে ষে থাকতেই হবে, তাই বা কি করে বলা যায়। মনগড় রূপও বড় কম যায় না। পাঠকের মনের উপর তার প্রতিক্রিয়াও বাস্তব রূপের চেয়েও কম নয়। তবে সেই রূপকে সর্বদা সত্যের বাহন হতে হবে । এই জন্যই ফ্যান্টাসির স্বষ্টি হয়েছে । কিন্তু এ-সব গল্পে বিভূতিভূষণ ও-পথ ধরেন নি। যতখানি সম্ভব তিনি বাস্তবকেই অবলম্বন করেছেন। ঘটনা অবিশুি বানানো। প্রকৃতির বর্ণনা ‘চাদের পাহাড় গল্পের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন বিভূতিভূষণ প্রকৃতি-প্রেমিক ছিলেন বটে, কিন্তু সে হল তার দেশের গ্রামের, কিম্বা প্রিয় ছোটনাগপুর, সিংহুম মানভূমের চেনা-জানা প্রকৃতি। এতে কিন্তু ঘথেষ্ট বলা হয় না। বর্তমান গ্রন্থের অকুস্থল মধ্য আফ্রিকা, সে সব জায়গা তিনি কখনো চোখে দেখেন নি। শুনেছি শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকারীরা নিজেদের দেখা জায়গা তাদের লেখার মধ্য দিয়ে অপরকে দেখাতে পারেন। বিভূতিভূষণ আরো এক-কাটি বাড়া। না দেখা জায়গাও তিনি অপরের সামনে জীবস্ত ছবির মতা তুলে ধরেছেন। এর অবশ্য একটা কারণও আছে । গল্পের নায়ক শঙ্করের গ্রামের বাড়ির দারিদ্র্যক্লিষ্ট বৈচিত্র্য-বিহীন জীবনের সঙ্গে অন্ত নামের গায়ে হলেও গ্রন্থকারের যথেষ্ট পরিচয় ছিল।