পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

|/o শঙ্করদের গায়ের একজন ফেরারী জামাই আফিকাতে নতুন রেলের লাইনের কাজে তাকে ঢুকিয়ে দিল। কাজটা অবিপ্তি নামে স্টেশন-মাস্টারি হলেও কেরানীগিরি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সেই নির্জন বনভূমিতে সিংহ ও সাপের অধ্যুষিত লীলাভূমির কেরানীও সাধারণ কেরানী হতে পারে না। তার উপর নির্জনতা আর স্বৰ্ষ ভুবলেই গাঢ় অন্ধকার । রাতে সিংহের ভয়ে ট্রেনও চলত না। সে সব দিন-রাতের ভীষণ-সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। চোখের সামনে যেন দেখা যায়। মনে হয় শুধু বই-এ পড়া মন-গড়া পরিবেশ এ নয়। হয়তো কেউ চক্ষুষ দেখে এসে তাকে মুখে মুখে বলেছিল। বার্ড কোম্পানির ভূ-বিদ্যা বিষয়ের ঐখামলকৃষ্ণ ঘোষের সঙ্গে বুভূতিভূষণের যথেষ্ট সৌহার্দ ছিল। হামলকৃষ্ণের শৈশব ও প্রথম যৌবন আফ্রিকায় কেটেছিল, ঠিক ঐ পরিবেশেই। হয়তো স্পর্শকাতর রেকর্ডিং যন্ত্রের মতো শু্যামলকৃষ্ণের সেই অনুভূতি বিভূতিভূষণের মনের ওপর প্রতিবিম্বিত হয়েছিল। তাই অল্প কথায় বলা সেই কাল্পনিক অভিজ্ঞতার বিষয় পড়ে গায়ে কাটা দেয়। নায়ক অবিখি সেখানে বেশিদিন থাকে নি, গুপ্তধনের সন্ধানে বিদেশী সঙ্গীর সঙ্গে দুর্গম গিরি কাস্তার মরু পার হয়ে ফিরেছিল। 蠟 "চাদের পাহাড়” নামটিও মন-গড় নয়, সত্যিকার আফ্রিকার সত্যিকার পাহাড়ের স্থানীয় নামের অনুবাদ মাত্র। গল্পে বর্ণিত গাছ-পালা, পশু-পাখি, ভূ-গর্ভের সম্পদ, স্থানীয় অধিবাসীদের আচার, আচরণ, আহার-বিহার সব-ই বাস্তবানুগ। বনময় পাহাড় চড়ার ক্লেশ-ক্লাস্তি পর্যস্ত বাস্তব এবং রচয়িতার অভিজ্ঞতা-প্রস্থত। যদিও যে অভিজ্ঞতা মানভূমে সিংডুমে আহৃত, আফ্রিকাতে নয়। একজন সাহিত্যিকের মধ্যে একটি সমগ্র মননশীলতা থাকে, যদিও তার প্রতিভা নানান্‌ দিকে বিচিত্রভাবে বিচ্ছুরিত হতে পারে। বলিষ্ঠ লেখকের নিজের সাহিত্য-সত্তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকে না। ষে বিভূতিভূষণ “পথের পাঁচালী” “আরণ্যক” লিখেছেন, তিনিই, এবং একমাত্র তিনিই নিঃসন্দেহে ছোটদের জন্য এই কাহিনীগুলি রচনা করেছেন । এই প্রসঙ্গে বর্তমান রচনাবলীর ষষ্ঠ খণ্ডের ভূমিকাতে ঐযুক্ত গোপাল হালদারের উক্তির কথা মনে পড়ে। বিভূতিভূষণের মূল সাহিত্য-পরিচয়ের বিষয়ে তিনি লিখেছেন, “...তার মূল স্বত্রগুলি--একবার নির্দেশ করা যেতে পারে।--জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে সহজ বিস্ময়-দৃষ্টি, কতকটা ত কবি-স্থলভ, কতকটা শিশু-স্বলভ, কিন্তু সততায় স্বস্থির , অকৃত্রিম নিসর্গাহভূতি বা প্রকৃতিপ্রীতি , অকুষ্ঠিত রহস্তানুভূতি বা অস্তমুখিতা এবং সাধারণ জীবনযাত্রার ঐ ও মাধুর্য-বোধ— এই চার সীমায় বিভূতিভূষণের মূল সাহিত্য পরিচয়কে স্থাপিত করা যায়। কথাগুলি অসুশীলন করলেই বোঝা যায় যে ঠিক এই উপাদানেই শিশু-সাহিত্যও তৈরি হয়। সমরসেট ম’ম এক জায়গায় লিখেছিলেন যে গদ্যের আদর থাকে চল্লিশ বছর, কিন্তু কাব্যের আদর চিরন্তন। অর্থাৎ চল্লিশ বছরের মধ্যে যে কোনো গল্পের বইয়ের বিষয়-বস্তু পুরনো ও সে-কেলে হয়ে যায়, কাজেই পাঠকদের আর আকৃষ্ট করে না। কিন্তু কাব্য লেখা হয় হৃদয়ের চিরন্তন সামগ্ৰী দিয়ে ; সেগুলি স্থান-কাল-পাঞ্জের হিসাবের বাইরে । এই