পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৫৬ বিভূতি-রচনাবলী ভাবলাম, আর নিশিঝর্ণা দেখে দরকার নেই, এবার যে পথে এসেছি সেই পথেই ফিরি। কিন্তু কোথায় সে পথ ? ক্রমে এমন সব জায়গার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখান দিয়ে আসবার সময় আসিনি তা বেশ বুঝলাম। বনের মধ্যে দিকভ্ৰাস্ত হওয়া খুব সহজ, বিশেষ করে এ ধরনের নিবিড় বনের মধ্যে। কিন্তু আমি জানি ধনঝরি উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব কোণের দিকে বিস্তৃত, বিশেষতঃ সূৰ্য্য যখন এখনও আকাশে দেখা যাচ্ছে, তখন দিক ভুলের সম্ভাবনা অন্তত: নেই—এই একটা ভরসা ছিল মনে । কিন্তু ভরসা ভরসাই রয়ে গেল সেই পৰ্য্যস্ত, কোনও কাজে এলো না । সূৰ্য্য ক্রমে পাহাড়ের আড়ালে অন্ত গেল। ছায়া ঘনিয়ে এলো বনে। যদিও সামনে জ্যোৎস্ব রাত্রি, তবুও এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে একা রান্ত্রি কাটানোর সম্ভাবনায় বিশেষ পুলকিত হয়ে উঠলাম না। -> হঠাৎ মনে হ’ল ধনঝরি পাহাড়ের ওপারেই তো মুসাবনী রোড। পাহাডটা যদি কোনও রকমে টপকাতে পারি, এখনও রাত হয় নি, লোকালয়ে পৌছতে পারবো। নতুবা ঘনায়মান সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলো-অন্ধকারে যতই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরবে ততই সম্পূর্ণরূপে পথভ্রান্ত হয়ে পড়তে হবে। একটা জায়গায় মনে হ’ল ধেন ধনারি একটু নিচু হয়েচে । এই ধরণের নিচু খাজ দিয়েই আমার জানা পায়ে-চলার স্বড়িপথটা গেছে—ঘন চুলের মধ্যে চেরা সিথির মতো ; পাৰ্ব্বত্য পথের কোন চিহ্নই দেখছি না কোন দিকে, তবুও এই অপেক্ষাকৃত নিচু থাক টপকে ধনঝরির ওপারে যাওয়া খুব কঠিন হবে না মনে হয়। জুতো খুলে হাতে নিলাম। পাহাড়ের কিছুদূর উঠে গিয়ে দেখি নিচে বনের মধ্যে যত অন্ধকার ওপর ততটা নয়। জ্যোৎস্ব উঠলো, জ্যোৎস্ব ফুটবে ভালো। প্রথম খানিকট উঠেই মনে হ’ল ভুল জায়গা দিয়ে পাহাড় পার হচ্ছি, এখান দিয়ে কখনও কেউ পাহাড় পার হয়নি-যেমন বড় বড় পাথরের চাই, তেমনি কাটা গাছ সৰ্ব্বত্র। খালি পায়ে ধারালো পাথরের ওপর দিয়ে চলতে বিষম কষ্ট, অথচ জুতো পায়ে দেওয়াও চলে না । পাহাড়ের ওপরে খানিকটা উঠে গেলাম দিব্যি। তারপরে এক জায়গায় গিয়ে দেখি সামনে একেবারে খাড়াই—দুরারোহ পাহাড দেওয়ালের মতো উঠেচে । বড় বড় গাছের শেকড় ঝুলচে, যেন জলের তোড়ে নদীর পাড় ভেঙে পডেচে। আমি শিক্ষিত পৰ্ব্বতারোহণকারী নই, সেই খাড়া উত্তঙ্গ পাহাড়ের দেওয়াল বেয়ে ওঠা আমার পক্ষে তাই সম্পূর্ণ অসম্ভব। এদিক ওদিক চেয়ে দেখি একদিকে একটা মসৃণ প্রকাও শিলা আড়ভাবে শোয়ানো, সেখানা উচ্চতায় আন্দাজ কুড়ি-বাইশ হাত এবং চওড়ায় ত্রিশ-বত্রিশ হাত হবে। এ ধরণের পাথরকে এদেশে ‘রাগ বলে। ‘রাগ পার হওয়া বিপদজনক, কারণ হাত-পা দিয়ে ধরবার এতে কিছু থাকে না । তবে এখানা অস্তত: ৬০০ ডিগ্রি কোণ করে হেলে আছে বলে ভরসা হ’ল ; এই একমাত্র পথে পাহাড়ের ওপরের দিকে ওঠা চলবে এখন । জুতো যখন পায়ে নেই এক রকম করে চার হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে রাগ পার হয়ে ওপরে উঠলাম। তারপরে ওঠার বিশেষ কষ্ট নেই, শুধু অর্জন আর শুভ্র নিম্পত্র শিববৃক্ষের জঙ্গল, বাঁকাভাবে চীনের আলো এসে শিবৰুক্ষের দুধের মতো সাদা ধবধবে গুড়ির গায়ে