পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२० 哆 বিভূতি-রচনাবলী শঙ্কর রোগীর পাশে রাত জেগে বসে রইল। লোকটির শরীরে কিছু নেই। খুব সম্ভব কষ্ট ও অনাহার ওর অস্বগের কারণ। এই দূর বিদেশে ওর কেউ নেই—শঙ্কর না দেখলে ওকে দেখবে কে ? “বাল্যকাল থেকেই পরের দুঃখ সহ্য করতে পারে না সে—শঙ্কর ধেভাবে সারা রাত তার সেবা করলে, তার কোনো আপনার লোক ওর চেয়ে বেশী কিছু করতে পারতে না। উত্তর-পূর্ব কোণের অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণীর পেছন থেকে চাদ উঠছে যখন সে রাত্রে—ঝম বাম করছে নিস্তব্ধ নিশীথ রাত্রি—তখন হঠাৎ প্রাস্তরের মধ্যে ভীষণ সিংহ-গর্জন শোনা গেল । রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল—সিংহের ডাকে সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। শঙ্কর বললে— ভয় নেই—শুয়ে থাকে। বাইরে সিংহ ডাকছে। দরজা বন্ধ আছে।. ‘ তার পর শঙ্কর আস্তে আস্তে দরজা খুলে প্ল্যাটফৰ্ম্মে এসে দাডালে । দাড়িয়ে চারিধারে দেখবামাত্রই যেন সে রাত্রির অপূৰ্ব্ব দৃশু তাকে भूध করে ফেললে। চাদ উঠছে দূরের আকাশপ্রাস্তে-ইউকা গাছের লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, ঘাসের বন যেন রহস্যময় নিম্পন্দ । সিংহ ডাকছে স্টেশনে কোয়ার্টারের পেছনে প্রায় পাচশো গজের মধ্যে । কিন্তু সিংহের ডাক আজকাল গা-সওয়া হয়ে উঠেছে—ণ্ডতে আর আগের মত ভয় পায় ন। রাত্রির সৌন্দর্য্য এত আকৃষ্ট করেছে ওকে, যে ও সিংহের সান্নিধ্য যেন ভুলে গেল । ফিরে ও স্টেশন ঘরে ঢুকল। টং টং করে ঘড়িতে দুটে। বেজে গেল। ঘরে ঢুকে দেখলে রোগী বিছানায় উঠে বসে আছে। বললে—একটু জল দাও, খাবো। লোকটা বেশ ভাল ইরিজি বলতে পারে। শঙ্কর টিন থেকে জল নিয়ে ওকে খাওয়ালে । লোকটার জর তখন যেন কমেছে। সে বললে—তুমি কি বলছিলে ? আমার ভয় করছে ভাবছিলে ? ডিয়েগো আলভারেজ ভয় করবে ? ইয়াং ম্যান, তুমি ডিয়েগে। আলভারেজকে জানো না। লোকটার ওষ্ঠপ্রান্তে একটা হতাশা, বিষাদ ও ব্যঙ্গ মিশানো অদ্ভূত ধরনের হাসি দেখা দিলে। সে অবসন্ন ভাবে বালিশের গায়ে ঢলে পড়ল। ওই হাসিতে শঙ্করের মনে হল এ লোক সাধারণ লোক নয়। তখন ওর হাতের দিকে নজর পড়ল শঙ্করের। বেঁটে বেঁটে মোট মোট আঙ্গুল—দাডির মত শিরাবহুল হাত, তাম্রাভ দড়ির নীচে চিবুকের ভাব শক্ত মানুষের পরিচয় দিচ্ছে। এতক্ষণ পরে খানিকটা জর কমে যাওয়াতে আসল মানুষটা বেরিয়ে আসছে যেন ধীরে ধীরে। লোকটা বললে—সরে এসে কাছে। তুমি আমার যথেষ্ট উপকার করেছ। আমার নিজের ছেলে থাকলে এর বেশী করতে পারতো না। তবে একটা কথা বলি—আমি বঁাচবে। না। আমার মন বলছে আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। তোমার উপকার করে যেতে চাই। তুমি ইণ্ডিয়ান ? এখানে কত মাহনে পাও? এই সামান্য মাইনের জন্যে দেশ ছেড়ে এত দূর এসে আছ যখন, তখন তোমার সাহস আছে, কষ্ট সহ্য করবার শক্তি আছে । আমার কথা মন দিয়ে শোনো, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে আজ তোমাকে যে-সব কথা বলবো—আমার মৃত্যুর পূৰ্ব্বে তা তুমি কারো কাছে প্রকাশ করবে না ?