পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী গাঙ্গোত প্রজার একখানা খুপড়ি। তাহার স্ত্রী ছ-মাসের শিশু লইয়া খুপড়ির মধ্যে শুইয়া ছিল —অসম্ভব শীতের দরুন খুপড়ির মধ্যেই আগুন জালানো ছিল, এবং ধোয়া বাহির করিয়া দিবার জন্ত দরজার ঝাপটা একটু ফাক ছিল। সেই পথে বাঘ ঢুকিয় ছেলেটিকে লইয়া পলাইয়াছে। কি করিয়া জানা গেল বাঘ ? শিয়ালও তো হইতে পারে। কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌছিয়া আর কোন সন্দেহ রহিল না, ফসলের ক্ষেতের নরম মাটিতে স্পষ্ট বাঘের থাবার দাগ । আমার পাটােয়ারী ও সিপাহীরা মহালে অপবাদ রটিতে দিতে চায় না, তাহার জো, গলার বলিতে লাগিল—এ আমাদের বাঘ নয় হুজুর, এ মোহনপুর রিজার্ভ ফরেস্টের বাঘ। দেখুন না কত বড় থাবা ! যাহাদেরই বাঘ হউক, তাহাতে কিছু আসে যায় না। বলিলাম, সব লোক জড় কর, মশাল তৈরি কর—চল জঙ্গলের মধ্যে দেখি । সেই রাত্রে অত বড় বাঘের পায়ের সদ্য থাবা দেখিয়া ততক্ষণ সকলেই ভরে কঁাপিতে শুরু করিয়াছে—জঙ্গলের মধ্যে কেহ যাইতে রাজী নয়। ধমক ও গালমন্দ দিয়া জন-দশেক লোক জুটাইয়া মশাল হাতে টিন পিটাইতে পিটাইতে সবাই মিলিয়া জঙ্গলের নানা স্থানে বৃথা অমুসন্ধান করা গেল । পরদিন বেলা দশটার সময় মাইল-দুই দূরে দক্ষিণপূৰ্ব্ব কোণের ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা বড় আসান-গাছের তলায় শিশুটির রক্তাক্ত দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হইল । কৃষ্ণপক্ষের কি ভীষণ অন্ধকার রাত্রিগুলিই নামিল তাহার পরে ! সদর কাছারি হইতে বাকে সিং জমাদারকে আনাইলাম। বাকে সিং শিকারী, বাঘের গতিবিধির অভ্যাস তার ভালই জানা । সে বলিল, হুজুর, মানুষখেকো বাঘ বড় ধূৰ্ত্ত হয় । আর কীট লোক মরবে। সাবধান হয়ে থাকতে হবে । ঠিক তিনদিন পরেই বনের ধারে সন্ধার সময় একটা রাখালকে বাঘে লইয়া গেল। ইহার পরে লোকে ঘুম বন্ধ করিয়া দিল। রাত্রে এক অপরূপ ব্যাপার! বিস্তীর্ণ বইহারের বিভিন্ন খুপড়ি হইতে সারা রাত টিনের ক্যানেক্স পিটাইতেছে, মাঝে মাঝে কাশের ভাটার অঁাটি জালাইয়া আগুন করিয়াছে, আমি বঁাকে সিং প্রহরে প্রহরে বন্দুকের দ্যাওড় করিতেছি। আর শুধুই কি বাঘ ? ইহার মধ্যে একদিন মোহনপুরা ফরেস্ট হইতে বন্ত-মহিষের দল বাহির হইয়া অনেকখানি ক্ষেতের ফসল তচনচ করিয়া দিল । আমার কাশের খুপড়ির দরজার কাছেই সিপাহীরা খুব আগুন করিয়া রাখিয়াছে। মাঝে মাঝে উঠয় তাহাতে কাঠ ফেলিয়া দিই। পাশের খুপড়িতে সিপাহীরা কথাবাৰ্ত্ত বলিতেছে— খুপড়ির মেঝেতেই শুইয়া আছি, মাথার কাছের ঘুলঘুলি দিয়া দেখা যাইতেছে ঘন অন্ধকারেঘেরা বিস্তীর্ণ প্রান্তর, দূরে ক্ষীণতারার আলোর পরিদৃগুমান জঙ্গলের আবছায়া সীমারেখা। অন্ধকার আকাশের দিকে চাহিয়া মনে হইল, যেন মৃত নক্ষত্ৰলোক হইতে তুষারবী হিমবাতাস তরঙ্গ তুলিয়া ছুটির আসিতেছে পৃথিবীর দিকে—লেপ তোশক হিমে ঠাও। জল হইয়া গিয়াছে, আগুন নিবিয়া আসিতেছে, কি দুরন্ত শীত। আর সেই সঙ্গে উন্মুক্ত প্রাস্তরের