পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক >e ○ তখন আবার খেড়ী কাটা শুরু হবে আপনাদেরই এখানে। তার পর কিছুদিন ছুটি । শ্রাবণভদ্রে আবার মকাই ফসলের সময় আসবে। মকাই শেষ হলেই কলাই এবং ধরমপুর-পূর্ণিয় অঞ্চলে কান্তিকশাল ধান। আমরা সারা বছর এই রকম দেশে দেশেই ঘুরে বেড়াই । যেখানে যে সমসে যে ফসল, সেখানে যাই। নইলে খাব কি ? —বাড়ী-ঘর বলে তোমাদের কিছু নেই ? এবার মেয়েটি কথা বলিল। মেয়েটির বয়স চব্বিশ-পচিশ খুব স্বাস্থ্যবতী, বাণিশ-কর কালে রং, নিটোল গড়ন। কথাবার্তা বেশ বলিতে পারে, আর গলার সুরটা দক্ষিণ-বিহারের দেহাতী হিন্দীতে বড় চমৎকার শোনায় । বলিল—কেন থাকবে না বাবুজী ? সবই আছে। কিন্তু সেখানে থাকলে আমাদের তো চলে না। সেখানে যাব গরম কালের শেষে, শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি পর্য্যস্ত থাকব । তার পর আবার বেরুতে হবে বিদেশে—বিদেশেই যখন আমাদের চাকরী। তা ছাড়া বিদেশে কত কি মজা দেখা যায়—এই দেখবেন ফসল কাটা হয়ে গেলে আপনাদের এখানেই কত দেশ থেকে কত লোক আসবে। কত বাজিয়ে, গাইয়ে, নাচনেওয়ালী, কত বহুরূপী সং— আপনি বোধ হয় দেখেন নি এসব ? কি করে দেখবেন, আপনাদের এ অঞ্চলে তো ঘোর জঙ্গল হয়ে পড়ে ছিল—সবে এইবার চাষ হয়েছে। এই দেখুন না আসে আর পনের দিনের মধ্যেই। এই তো সবারই রোজগারের সময় আসছে। চারিদিক নির্জন। দূরের বস্তিতে কারা টিন পিটাইতেছে অন্ধকারের মধ্যে। মনে ভাবিলাম, এই অর্গলহীন কাশডাটার বেড়ার আগড়-দেওয়া কুঁড়েতে ইহার রাত কাটাইবে এই শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যের ধারে, ছেলেপুলে লইয়া - সাহসও আছে বলিতে হইবে। এই তো মাত্র দিন কয়েক আগে “দেরই মত আর একটা খুপড়ি হইতে ছেলে লইয়া গিয়াছে মায়ের কোল হইতে—এদেরই বা ভরসা কিসের? অথচ একটা ব্যাপার দেখিলাম, ইহার যেন ব্যাপারটা গ্রাহের মধ্যেই আনিতেছে না । তত সন্ত্রস্ত ভাবও নাই। এই তো এত রাত পৰ্য্যন্ত উন্মুক্ত আকাশের তলায় বসিয়া গল্পগুজব, রান্নাবান্না করিল। বলিলাম— তোমরা একটু সাবধানে থাকবে। মানুষখেকো বাঘ বেরিয়েছে জান তো ? মানুষ-থেকে বাঘ বড় ভয়ানক জানোয়ার, আর বড় ধূৰ্ত্ত। অগুন রাখে। খুপড়ির সামনে, আর ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়। ঐ তো কাছেই বন, রাত-বেরাতের ব্যাপার মেয়েটি বলিল—বাবুজী, আমাদের সয়ে গিয়েছে। পূর্ণিয়া জেলায় যেখানে ফি-বছর ধান কাটতে যাই, সেখানে পাহাড় থেকে বুনো হাতী নামে। সে জঙ্গল আরও ভয়ানক । ধানের সময় বিশেষ করে বুনো হাতীর দল এসে উপদ্রব করে। মেয়েটি আগুনের মধ্যে আর কিছু শুক্নো বনঝাউয়ের ডাল ফেলিয়া দিয়া সামনের দিকে সরিয়া আসিয়া বসিল । বলিল—সেবার আমরা অধিলকুচা পাহাড়ের নীচে ছিলাম। একদিন রাত্রে এক খুপড়ির বাইরে রান্না করছি, চেয়ে দেখি পঞ্চাশ হাত দূরে চার-পাচটা-বুনে-হাতী—কালে কালো