পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী 8 هد পাহাড়ের মত দেখাচ্ছে অন্ধকারে—যেন আমাদের খুপড়ির দিকেই আসছে। আমি ছোট ছেলেটাকে বুকে নিয়ে বড় মেয়েটার হাত ধরে রান্না ফেলে খুপড়ির মধ্যে তাদের রেখে এলাম। কাছে আর কোনো লোকজন নেই, বাইরে এসে দেখি তখন হাতী ক'টা একটু থমকে দাডিয়েছে। ভয়ে আমার গল কাঠ হয়ে গিয়েছে। হাতীতে খুব দেখতে পায় না তাই রক্ষে—ওরা বাতাসে গন্ধ পেরে দূরের মানুষ বুঝতে পারে। তখন বোধ হয় বাতাস অন্ত দিকে বইছিল, যাই হোক, তারা অন্ত দিকে চলে গেল। ওঃ, সেখানেও এমনি বাবুজী সারা রাত টিন পেটায় আর আলো জালিয়ে রাখে হাতীর ভয়ে। এখানে বুনো মহিষ, সেখানে বুনো হাতী। ওসব গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। রাত বেশী হওয়াতে নিজের বাসায় ফিরিলাম । দিন পনেরোর মধ্যে ফুলকিয়া বইহারের চেহারা বদলাইয়া গেল। সরিষার গাছ শুকাইয়া মাড়িয়া বীজ বাহির করিবার সঙ্গে সঙ্গে কোথা হইতে দলে দলে নানা শ্রেণীর লোক আসিয়া জুটিতে লাগিল। পূর্ণিয়া, মুঙ্গের, ছাপরা প্রভৃতি স্থান হইতে মারোয়াড়ী ব্যবসায়ীরা দাড়িপাল্লা ও বস্তা লইয়া আসিল মাল কিনিতে। তাহীদের সঙ্গে কুলির ও গাডোয়ানের কাজ করিতে আসিল এক দল লোক। হালুইকররা আসিয়া অস্থায়ী কাশের ঘর তুলিয়া মিঠাইয়ের দোকান খুলিয়া সতেজে পুরী, কচেরি, লাড কালাকন, বিক্রয় করিতে লাগিল। ফিরিওয়ালার নানা রকম সস্তা ও খেলে মনোহারী জিনিস, কাচের বাসন, পুতুল, সিগারেট, ছিটের কাপড়, সাবান ইত্যাদি লইয়া আসিল । এ বাদে আসিল রং-তামাসা দেখাইয়া পয়সা রোজগার করিতে কত ধরনের লোক । নাচ দেখাইতে, রামসীতা সাজিয়া ভক্তের পূজা পাইতে, হনুমানজীর সি হুরমাখা মুৰ্বি-হাতে পাণ্ডাঠাকুর আসিল প্রণামী কুড়াইতে । এ সময় সকলেরই দু-পয়সা রোজগারের সময় এসব অঞ্চলে । আর-বছরও যে জনশূন্ত ফুলকিয়া বইহারের প্রান্তর ও জঙ্গল দিয়া, বেলা পড়িয়া গেলে, ঘোড়ায় যাইতেও ভয় করিত—এ-বছর তাহার আনন্দোৎফুল্ল মূৰ্ত্তি দেখিয়া চমৎকৃত হইতে হয়। চারিদিকে বালক-বালিকার হাস্যধ্বনি, কলরব, সস্তা টিনের ভেপুর পিপি বাজনা, ঝুমঝুমির আওয়াজ, নাচিয়েদের ঘুঙুরের ধ্বনি—সমস্ত ফুলকিয়ার বিরাট প্রান্তর জুড়িরা যেন একটা বিশাল মেলা বসিয়া গিয়াছে । লোকসংখ্যাও বাড়িয়া গিয়াছে অত্যন্ত বেশী। কত নুতন খুপ্রডি, কাশের লম্বা চালাঘর চারিদিকে রাতারাতি উঠিয় গেল। ঘর তুলিতে ওখানে কোন খরচ নাই, জঙ্গলে আছে কাশ ও বনঝাউ কি কেঁদ-গাছের গুড়ি ও ডাল, শুকনো কাশের ডাটার খোলা পাকাইয়া এদেশে একরকম ভারি শক্ত রশি তৈরি করে, আর আছে ওদের নিজেদের শারীরিক পরিশ্রম। ফুলকিয়ার তহশীলদার আসিয়া জানাইল, এই সব বাহিরের লোক, যাহার এখানে পয়সা রোজগার করিতে আসিয়াছে, ইহাদের কাছে জমিদারের খাজনা আদায় করিতে হইবে। বলিল—আপনি রীতিমত কাছারি করুন হুজুর, আমি সব লোক একে একে আপনার