পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বারণ্যক ჯ o & —কিছুই পাই নি, খাজনা দেব কোথা থেকে ? নাচ দেখিয়ে সর্ষে পেরেছিলাম, তা বেচে ক'দিন পেটে খেয়েছি। হকুমানজীর কিরিয়া । সিপাহীরা বলিল—সব মিথ্যে কথা। শুনবেন না হুজুর। ও অনেক টাকা রোজগার করেছে। ওর কাছেই আছে। হুকুম করেন তো ওর কাপড়চোপড় সন্ধান করি। লোকটা ভয়ে হাতজোড় করিয়া বলিল-হুজুর, আমি বলছি আমার কাছে কত আছে। পরে কোমর হইতে একটা গেজে বাহির করিয়া উপুড় করিয়া ঢালিয়া বলিল—এই দেখুন হুজুর, তের আনা পয়সা আছে। আমার কেউ নেই, এই বুড়ে বয়সে কে-ই বা আমার দেবে ? আমি নাচ দেখিয়ে এই ফসলের সময় খামারে খামারে বেড়িয়ে যা রোজগার করি । আবার সেই গমের সময় পৰ্য্যন্ত এতেই চালাব। তার এখনও তিন মাস দেরি। যা পাই পেটে দুটো খাই, এই পৰ্য্যন্ত। সিপাহীরা বলেছে, আমার নাকি আট আনা খাজনা দিতে হবেতা হলে আমার আর রইল মোট পাচ আনা । পাচ অনায় তিন মাস কি খাব ? বলিলাম—তোমরা হাতে ও পোটলাতে কি আছে ? বার কর । লোকটা পোটল খুলিয়া দেখাইল তাহাতে আছে ছোট্ট একথান টিনমোড়া আর্সি, একটা রাঙতার মুকুট—ময়ুরপাথ সমেত, গালে মাখিবার রং, গলায় পরিবার পুতির মালা ইত্যাদি— কৃষ্ণঠাকুর সাজিবার উপকরণ। বলিল—দেখুন, তবুও বাণী নেই হুজুর। একটা টিনের বড় বাশী আট আনার কম হবে না। এখানে নলখাগড়ার বঁাশীতে কাজ চালিয়েছি। এরা গাঙ্গোত জাত, এদের ভুলানো সহজ। কিন্তু আমাদের মুঙ্গের জেলার লোক সব বড় এলেমদার। বাশী না হলে হাসবে। কেউ পয়সা দেবে না । আমি বলিলাম-বেশ, মি খাজনা দিতে না পার, নাচ দেখিয়ে যাও, খাজনার বদলে। বৃদ্ধ হাতে যেন স্বৰ্গ পাইয়াছে এমন ভাব দেখাইল। তাহার পর গালেমুখে রং মাখিয়া ময়ুরপাখা মাথায় ঐ বয়সে সে যখ- বারে বছরের বালকের ভঙ্গিতে হেলিয়া দুলিয়া হাত নাড়িয়া নাচিতে নাচিতে গান ধরিল—তখন হাসিব কি কঁদিব স্থির করিতে পারিলাম না । আমার সিপাহীরা তো মুখে কাপড় দিয়া বিদ্ধপের হাসি চাপিতে প্রাণপণ করিতেছে। তাহাদের চক্ষে ননীচের নাটুয়া'র না এক মারাত্মক ব্যাপারে পরিণত হইল। বেচারীরা ম্যানেজারবাবুর সামনে না পারে প্রাণ খুলিয়া হাসিতে, না পারে দুৰ্দ্দমনীয় হাসির বেগ সামলাইতে । সে রকম অদ্ভূত নাচ কখনও দেখি নাই, ষাট বছরের বৃদ্ধ কখনও বালকের মত অভিমানে ঠোঁট ফুলাইয়া কাল্পনিক জননী যশোদার নিকট হইতে দূরে চলিয়া আসিতেছে, কখনও একগাল হাসিয়া সঙ্গী রাখাল বালকগণের মধ্যে চোরা-ননী বিতরণ করিতেছে, যশোদা হাত বাধিয়া রাখিয়াছেন বলিয়া কখনও জোড়-হাতে চোখের জল মুছিয়া খুৎ ধুৎ করিয়া বালকের সুরে কাদিতেছে। “ সমস্ত জিনিস দেখিলে হাসিতে হাসিতে পেটের নাড়ী ছিড়িয়া যায়।