পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক >s> পৃথিবীর টুরিস্টদের লীলাভূমি, পাবলিসিটি ও ঢাক পিটানোর অনুগ্রহে সেখানকার বড় বড় হোটেলগুলি মরশুমের সময় লোকে গিজগিজ করে—“ভ্যালি অব দি কিংস অতীত কালের কুয়াসায় যত না অন্ধকার হইয়াছিল, তার অপেক্ষাও অন্ধকার হইয়া যায় দামী সিগারেট ৪ চুরুটের ধোয়ায়.কিন্তু তার চেয়ে কোন অংশে রহস্তে ও স্বপ্রতিষ্ঠ মহিমার কম নয় স্বর অতীতের এই অনাৰ্য নৃপতিদের সমাধিস্থল, ঘন অরণ্যভূমির ছায়ার শৈলশ্রেণীর অন্তরালে যা চিরকাল আত্মগোপন করিয়া আছে ও থাকিবে । এদের সমাধিস্থলে আড়ম্বর নাই, পালিশ নাই, ঐশ্বৰ্য্য নাই, মিশরীয় ধনী ফ্যারাওদের কীর্টির মত—কারণ এরা ছিল দরিদ্র, এদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল মানুষের আদিম যুগের অশিক্ষিতপটু সভ্যতা ও সংস্কৃতি, নিতান্ত শিশু-মানবের মন লইয়া ইহার রচনা করিয়াছে ইহাদেব গুহানিহিত রাজপ্রাসাদ, রাজসমাধি, সীমানাজ্ঞাপক খুটি । সেই অপরাহের ছায়ায় পাহাড়ের উপর সে বিশাল তরুতলে দাড়াইয়া যেন সৰ্ব্বব্যাপী শাশ্বত কালের পিছন দিকে বহুদূরে অন্ত এক অভিজ্ঞতার জগৎ দেখিতে পাইলাম—পৌরাণিক ও বৈদিক যুগ ও যার তুলনায় বৰ্ত্তমানের পর্যায়ে পড়িয়া যায়। দেখিতে পাইলাম যাযাবর আর্য্যগণ উত্তর-পশ্চিম গিরিবত্ম অতিক্রম করিয়া স্রোতের মত অনার্যা-আদিমজাতি-শাসিত প্রাচীন ভারতে প্রবেশ করিতেছেন.ভারতের পরবর্তী যা কিছু ইতিহাস—এই আর্য্যসভ্যতার ইতিহাস—বিজিত অনাৰ্য্য জাতিদের ইতিহাস কোথাও লেখা নাই—কিংবা সে লেখা আছে এই সব গুপ্ত গিরিগুহায়, অরণ্যানীর অন্ধকারে, চূর্ণায়মান অস্থি-কঙ্কালের রেখায়। সে লিপির পাঠোদ্ধার করিতে বিজয়ী আর্য্যজাতি কখনও ব্যস্ত হয় নাই। আজও বিজিত হতভাগ্য আদিম জাতিগণ তেমনই অবহেলিত, অবমানিত, উপেক্ষিত। সভ্যতাদপী আৰ্য্যগণ তাহদের দিকে কখনও ফিরিয়া চাহে নাই, তাহীদের সভ্যতা বুঝিবার চেষ্টা করে নাই, আজও করে না। আমি, বনোয়ারী সেই বিজয়ী জাতির প্রতিনিধি ; বৃদ্ধ দেবেরু পান্না, তরুণ যুবক জগরু, তরুণী কুমারী ভানুমতী সেই বিজিত, পদদলিত জাতির প্রতিনিধি—উভয় জাতি আমরা এই সন্ধ্যার অন্ধকারে মুখোমুখি দাড়াইয়াছি— সভ্যতার গর্বে উন্নতনাসিক আৰ্য্যকান্তির গৰ্ব্বে আমি প্রাচীন অভিজাতবংশীয় দেবেরু পান্নাকে বৃদ্ধ সাওতাল ভাবিতেছি, রাজকন্ত ভানুমতীকে মুণ্ডা কুলী-রমণী ভাবিতেছি—তাদের কত আগ্রহের ও গর্বের সহিত প্রদর্শিত রাজপ্রাসাদকে অনাৰ্য্যমুলভ আলো-বাতাসহীন গুহাবাস, সাপ ও ভূতের আড্ডা বলিয়া ভাবিড়েছি। ইতিহাসের এই বিরাট ট্রাজেডি যেন আমার চোখের সম্মুখে সেই সন্ধ্যায় অভিনীত হইল—সে নাটকের কুশীলবগণ এক দিকে বিজিত উপেক্ষিত দরিদ্র অনাৰ্য্য নৃপতি দেবিরু পান্না, তরুণী অনাৰ্য্য রাজকন্ত ভানুমতী, তরুণ রাজপুত্র জগরু পান্না—এক দিকে আমি, আমার, পাটোয়ারী বনোয়ারীলাল ও আমার পথপ্রদর্শক বুদ্ধ, সিং। - ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকারে রাজসমাধি ও বটতরুতল আবৃত হইবার পূৰ্ব্বেই আমরা সেদিন পাহাড় হইতে নামিয়া আসিলাম। " নামিবার পথে একস্থানে জঙ্গলের মধ্যে একখানা খাড়া পিচুরমাখা পাথর। আশে-পাশে