পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক ծԵ-Գ খাবেন, সজারু না হরিয়াল, না বনমোরগ ? স্নান করিয়া আসিলাম। ভানুমতী নিজের সেই আয়নাথানি (সেবার যেখানা পূর্ণিয় হইতে আনাইয়া দিয়াছিলাম) আর একখানা কাঠের কাকুই চুল আঁচড়াইবার জন্ত আনিয়া দিল । আহারাদির পর বিশ্রাম করিতেছি, বেল পড়িয়া আসিয়াছে, ভানুমতী প্রস্তাব করিল— বাবুজী চলুন, পাহাড়ে উঠবেন না। আপনি তো ভালবাসেন। যুগলপ্রসাদ ঘুমাইতেছিল, সে ঘুম ভাঙিয়া উঠিলে আমরা বেড়াইবার জন্য বাহির হইলাম। সঙ্গে রহিল ভানুমতী, ওর খুড়তুতো বোন—জগরু পান্নার মেজ ভাইয়ের মেয়ে, বছর বারো বয়স—আর যুগলপ্রসাদ । আধ মাইল ইটিয়া পাহাড়ের নীচে পৌছিলাম। ধনঝরির পাদমূলে এই জায়গার বনের দৃপ্ত এত অপূৰ্ব্ব যে, খানিকটা দাড়াইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। যেদিকে চোখ ফিরাই সেদিকেই বড় বড় গাছ, লতা উপল-বিছানো ঝরনার খাদ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট-বড় শিলাস্তুপ। ধন্বন্ধরির দিকে বন ও পাহাড়ের আড়ালে আকাশটা কেমন সরু হইয়া গিয়াছে, সামনে লাল কাকুরে মাটির রাস্ত উচু হইয়া ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়া পাহাড়ের ওপারের দিকে উঠিয়াছে, কেমন খট্রখটে শুকনো ডাঙা মাটি, কোথাও ভিজা নয়, তাৎসেতে নয়। ঝরনার খাদেও এতটুকু জল নাই । পাহাড়ের উপরে ঘন বন ঠেলিয়া কিছুদূর উঠতেই কিসের মধুর মুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল, গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত—প্রথমটা ধরিতে পারি নাই, তারপরে চারিদিকে চাহিয়া দেখি —ধৰ্ম্মরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ তাহ পূৰ্ব্বে লক্ষ্য করি নাই—এখন প্রথম হেমস্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াwে, তাহারই সুবাস । সে কি দু-চারটি ছাতিম গাছ । সপ্তপর্ণের বন, সপ্তপর্ণ আর কেলিকদম্ব-কদম্বফুলের গাছ নয়, কেলিকদম্ব ভিন্নজাতীয় বৃক্ষ, সেগুন পাতার মত বড় বড় পাতা, চমৎকার আঁকাবঁকা ভালপালাওয়ালা বনস্পতিশ্রেণীর বৃক্ষ। হেমস্তের অপরাহের শীতল বাতাসে পুষ্পিত বন্ত সপ্তপর্ণের ঘন বনে দাড়াইয়া নিটোল স্বাস্থ্যবর্তী কিশোরী ভানুমতীর দিকে চাহিয়া মনে হইল, মূৰ্ত্তিমতী বনদেবীর সঙ্গলাভ করিয়া ধন্ত হইয়াছি—কৃষ্ণা বনদেবী। রাজকুমঃ তো ও বটেই ! এই বনাঞ্চল, পাহাড়, ওই মিছি নদী, কারো নদীর উপত্যকা, এদিকে ধনঝরি ওদিকে নওয়াদার শৈলশ্রেণী—এই সমস্ত স্থান এক এক সময়ে যে পরাক্রান্ত রাজবংশের অধীনে ছিল, ও সেই রাজবংশের মেয়ে—আজ ভিন্ন যুগের আবহাওয়ায় ভিন্ন সভ্যতার সংঘাতে যে রাজবংশ বিপৰ্য্যস্ত, দরিদ্র, প্রভাবহীন-ভাই আজি ভানুমতীকে দেখিতেছি সাওতালী মেয়ের মত। ওকে দেখিলেই অলিখিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ট্র্যাজিক অধ্যায় আমার চোখের সামনে ফুটিয় ওঠে। আজকার এই অপরাহুটি আমার জীবনের আরও বহু মুন্দর অপরাহের সঙ্গে মিলিয়া মধুময় প্ৰতির সমারোহে উজ্জল হইয়া উঠিল—স্বপ্নের মৃত মধুর, স্বপ্নের মতই অবাস্তব।