পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক 있 শ’ গজ দূরের জিনিস ঘন বালি ও ধূলিরাশির আড়ালে ঢাকিয়া যায়। অৰ্দ্ধেক দিন রামধনিয়া টহলদার আসিয়া জানায়—কুয়ামে পানি নেই ছে, হুজুর। কোনকোন দিন ঘণ্টাখানেক ধরিয়া ছানিয়া ছানিয়া বালির ভিতর হইতে আধ বালতি তরল কদম স্নানের জন্য আমার সামনে আনিয়া ধরে। সেই ভয়ানক গ্রীষ্মে তাহাই তখন অমূল্য। একদিন দুপুরের পরে কাছারির পিছনে একটা হরীতকী গাছের তলায় স্বল্প ছায়ায় দাড়াইয়া আছি—হঠাৎ চারিধারে চাহিয়। মনে হইল দুপুরের এমন চেহারা কখনও দেখি তো নাই-ই, এ জায়গা হহঁতে চলিয়া গেলে আর কোথাও দেখিবও না। আজন্ম বাংলা দেশের ছপুৰ দেখিয়ছি—জ্যৈষ্ঠ মাসের খররেদ্রভরা দুপুর দেখিয়াছি কিন্তু এরুদ্রমূৰ্ত্তি তাহার নাই। এ ভীম-ভৈরব রূপ আমাকে মুগ্ধ করিল। স্বর্ঘ্যের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একটা বিরাট অগ্নিকুণ্ড-ক্যালসিয়াম পুড়িতেছে,হাইড্রোজেন পুড়িতেছে, লোহা পুড়িতেছে,নিকেল পুড়িতেছে, কোবান্ট পুড়িতেছে—জানা অজানা শত শত রকমের গ্যাস ও ধাতু কোটি যোজন ব্যাসমুক্ত দীপ্ত ফার্নেসে একসঙ্গে পুড়িতেছে-তারই ধুধু আগুনের ঢেউ অসীম শূন্তের ঈথারের স্তর ভেদ করিয়া ফুলকিয় বইহার ও লেধাইটোলার তৃণভূমিতে বিস্তীর্ণ অরণ্যে আসিয়া লাগিয়া প্রতি তৃণপত্রের শিরা উপশিরায় সব রসটুকু শুকাইয়া ঝামা করিয়া, দিগ দিগন্ত ঝলসাইয়া পুড়াইয়া শুরু করিয়াছে ধ্বংসের এক তাণ্ডব লীলা। চাহিয়া দেখিলাম দূরে দূরে প্রাস্তরের সর্বত্র কম্পমান তাপ-তরঙ্গ ও তাছার ওপারে তাপজনিত একটি অস্পষ্ট কুয়াশ। গ্রীষ্ম-দুপুরে কখনও এখানে আকাশ নীল দেখিলাম না—তাম্রাভ, কটা-শুন্ত, একটি চিল-শকুনিও নাই— পাখীর দল দেশ ছাডিয়া পলাইয়াছে। কি অদ্ভুত সৌন্দৰ্য্য ফুটিয়াছে এই দুপুরের! থর উত্তাপকে অগ্রাহ করিয়া সেই হরীতকীতলায় দাড়াইয়া রহিলাম কতক্ষণ। সাহারা দেখি নাই, সেভেন হেডিনের বিখ্যাত টাক্ল-মাকান মরুভূমি দেখি নাই, গোবি দেখি নাই—কিন্তু এখানে মধ্যাহ্নের এই রুদ্রভৈরব রূপের মধ্যে সে-সব স্থানের অস্পষ্ট আভাস ফুটিয়া উঠিল। কাছারি হইতে তিন মাইল রে একটি বনে-ঘেরা ক্ষুদ্র কুণ্ডীতে সামান্ত একটু জল ছিল, কুণ্ডীটাতে গত বর্ষার জলে খুব মাছ হইয়াছিল বলিয়া শুনিয়াছিলাম—খুব গভীর বলিয়া এই অনাবৃষ্টিতেও তাহার জল একেবারে শুকাইয়া যায় নাই । কিন্তু সে জলে কাহারও কোন কাজ হয় না—প্রথমত, তার কাছাকাছি অনেক দূর লইয়া কোন মানুষের বসতি নাই— দ্বিতীয়ত, জল ও তীরভূমর মধ্যে ক দা এত গভীর যে, কোমর পর্য্যন্ত বসিয়া যায়—কলসীতে জল পুরিয়া পুনরায় তীরে উত্তীর্ণ হবার আশা বড়ই কম। আর একটি কারণ এই যে, জলট খুব ভাল নয়—স্বান বা পানের আদৌ উপযুক্ত নয়, জলের সঙ্গে কি জিনিস মিশানো আছে জানি না-কিন্তু কেমন একটা অপ্রীতিকর ধাতব গন্ধ । s একদিন সন্ধ্যায় পশ্চিমে বাতাস ও উত্তাপ কম পড়িয়া গেলে ঘোড়ায় বাহির হইয়া ঐ কৃতীটার পাশের উচু বালিয়াডি ও বন-ঝাউয়ের জঙ্গলের পথে উপস্থিত হইয়াছি। পিছনে গ্র্যান্ট সাহেবের সেই বড় বটগাছের আড়ালে স্বৰ্য্য অস্ত যাইতেছিল। কাছারির খানিকটা জল বাচাইবার জন্ত ভাবিলাম, এখানে ঘোড়াটাকে একবার জল খাওয়াইয়া লই। যত কাদা