পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

‘LO বিভূতি-রচনাবলী সারা বৈকাল ঘুরিয়াছে—কোথাও একফোটা জল পায় নাই, একটা মানুষের সঙ্গে দেখা হয় নাই—রাত্রে অবসন্ন অবস্থায় এক গাছের তলায় শুইয়া ছিল—আজ সকাল হইতে আবার ঘোরা শুরু করিয়াছে—মাথা ঠাণ্ড রাখিলে সুৰ্য্য দেখিয়া দিক্ নির্ণয় করা হয়তো তার পক্ষে খুব কঠিন হইত না—অন্তত পূর্ণিয়াও ফিরিয়া যাইতে পারিত—কিন্তু ভয়ে দিশহারা হইয়া একবার এদিক একবার ওদিক ছুটাছুটি করিয়াছে আজ সারা দুপুর, তাহার উপর খুব চীৎকার করিয়া লোক ডাকিবার চেষ্টা করিয়াছে—কোথায় লোক ? ফুলকিয়া বইহারের কুলের জঙ্গল যেদিকে, সেদিক হইতে লবটুলিয়া পৰ্য্যন্ত দশ-বারো বর্গমাইল-ব্যাপী বনপ্রান্তর সম্পূর্ণ জনমানবশূন্ত, সুতরাং আশ্চর্য্যের বিষয় নয় যে, তাহার চীংকার কেহ শোনে নাই। আরও তাহার আতঙ্ক হইবার কারণ, সে ভাবিয়াছিল তাহাকে জঙ্গলের মধ্যে জিনপরীতে পাইয়াছে—মারিয়া না ফেলিয়া ছাডিবে না । তাহার গায়ে একটা জামা ছিল, কিন্তু আজ অসহ্য পিপাসায় দুপুরের পরে এমন গা-জলুনি শুক হইয়াছিল যে, জামাটা খুলিয়া কোথায় ফেলিয়া দিয়াছে। এ অবস্থায় দৈবক্রমে আমাদের কাছারির হকুমানের ধ্বজার লাল নিশানটা দূর হইতে তাহার চোখে না পড়িলে লোকটা আজ বেঘোরে মারা পড়িত। একদিন এই ঘোর উত্তাপ ও জলকষ্ট্রের দিনে ঠিক দুপুর বেলা সংবাদ পাইলাম, নৈঋত কোণে মাইল-খানেক দূরে জঙ্গলে ভয়ানক আগুন লাগিয়াছে এবং আগুন কাছারির দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। সবাই মিলিয়া তাড়াতাডি বাহির হইয়া দেখিলাম প্রচুর ধুমের সঙ্গে রাঙা অগ্নিশিখা লক্লক্ করিয়া বহুদূর আকাশে উঠিতেছে ; সেদিন আবার দারুন পশ্চিমে বাতাস, লম্বা লম্বা ঘাস ও বন-ঝাউয়ের জঙ্গল স্থৰ্য্যতাপে অৰ্দ্ধশুস্ক হইয়া বারুদের মত হইয়৷ আছে, এক-এক ফুলিঙ্গ পডিবামাত্র গোটা ঝাড জলিয়া উঠিতেছে—সেদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় ঘন নীলবর্ণ ধূমরাশি ও অগ্নিশিখা—আর চটচট শব্দ। ঝডের মুখে পশ্চিম হইতে পূৰ্ব্বদিকে বাকা আগুনের শিখা ঠিক যেন ডাক-গাড়ীর বেগে ছুটিয়া আসিতেছে আমাদের কয়খানা খড়ের বাংলোর দিকেই। সকলেরই মুখ শুকাইয়া গেল, এখানে থাকিলে আপাতত তো বেড়া-অগুনে ঝলসাইয়া মরিতে হয়—দাবনল তো আসিয়া পড়িল । ভাবিবার সময় নাই । কাছারির দরকারী কাগজপত্র, তহবিলের টাকা, সরকারী দলল ম্যাপ, সৰ্ব্বস্ব মজুত—এ বাদে আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিস যার যার তো আছেই। এ সব ত যায়! সিপাহীর শুল্কমুখে ভীতকণ্ঠে বলিল—আগতো আ গৈল, হুজুর! বলিলাম —সব জিনিস বার কর । সরকারী তহবিল ও কাগজপত্র আগে । জনকতক লোক লাগিয়া গেল আগুন ও কাছারির মধ্যে যে জঙ্গল পড়ে তাহারই যতটা পারা যায় কাটিয়া পরিষ্কার করিতে। জঙ্গলের মধ্যে বাগান হইতে আগুন দেখিয়া বাথানওয়ালা চরির প্রজা দু-দশ জন ছুটিয়া আসিল কাছারি রক্ষা করিতে, কারণ পশ্চিমা-বাতাসের বেগ দেখিয় তাহারা বুঝিতে পারিয়াছে কাছারি ঘোর বিপন্ন। কি অদ্ভুত দৃশু! জঙ্গল ভাঙ্গিয় ছিড়িয়া চুটিয়া পশ্চিম হইতে পূৰ্ব্বদিকে নীলগাইয়ের