পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক “ệđ: বলিল-রাইচি আর রেড়ির বীজ বিক্ৰী করে টাকা করেছিলাম হুজুর, নয়তো আমার পৈতৃক আমলের একটা ঘসা পয়সাও ছিল না। আমিই করেছি, আবার আমিই লোকসান দিচ্ছি। ব্যবসা করতে গেলে লাভ লোকসান আছেই হুজুর। তা আছে স্বীকার করি, কিন্তু কয়জন লোক এত বড ক্ষতি এমন শাস্তমুখে উদাসীনভাবে সহ করিতে পারে, সেই কথাই ভাবিতেছিলাম। তাহার বডমাচুৰী গৰ্ব্ব দেখিলাম মাত্র একটি ব্যাপারে ; একটা লাল কাপডের বাটুয়া হইতে সে মাঝে মাঝে ছোট একখানা জাতি ও সুপারি বাহির করিয়া কাটিয়া মুখে ফেলিয়া দেয়। আমার দিকে চাহিয়া হাসিমুখে একবার বলিয়াছিল—রোজ এক কনোয়া করে সুপুরি খাই বাবুজী। সুপুরির বড় খরচ আমার। বিত্তে নিস্পৃহতা ও বৃহৎ ক্ষতিকে তাচ্ছিল্য করিবার ক্ষমতা যদি দার্শনিকত হয়, তবে ধাওতাল সাহুর মত দার্শনিক আমি তো অন্ততঃ দেখি নাই । No) ফুলকিয়ার ভিতর দিয়া যাইবাব সময় আমি প্রতিবারই জয়পাল কুমারের মকাইয়ের পাতাছাওয়া ছোট ঘরখানার সামনে দিয়া যাইতাম। কুমাব অর্থে কুম্ভকার নয়, ভুইহার বামুন। খুব বড় একটা প্রাচীন পাকুড গাছের নীচেই জয়পালের ঘর। সংসারে সে সম্পূর্ণ এক, বয়সেও প্রাচীন, লম্বা রোগা চেহারা, মাথায় লম্বা সাদা চুল। যখনই যাইতাম, তখনই দেখিতম কুঁড়েঘরের দোরের গোডায় সে চুপ করিয়া বসিয়া আছে। জয়পাল তামাক খাইত না, কখনও তাকে কোন কাজ করিতে দেখিয়াছি বলিয়াও মনে হয় না, গান গাইতে শুনি নাই—সম্পূর্ণ কৰ্ম্মশূন্ত অবস্থায় শাহুষ কি ভাবে যে এমন ঠায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে, জানি না। জয়পালকে দেখিয়া বড় বিস্ময় ও কৌতুহল বোধ করিতাম। প্রতিবারই উহার ঘরের সামনে ঘোড থামাইয়া উহার সহি , দুটা কথা না বলিয়া যাইতে পারিতাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম--জয়পাল, কি কর বসে ? —এই, বসে আছি হুজুর। —বয়েস কত হল ? —তা হিসেব রাখিনি, তবে যেবার কুশীনদীর পুল হয়, তখন আমি মহিষ চরাতে পারি। —বিয়ে করেছিলে ? ছেলেপুলে ছিল ? —পরিবার মরে গিয়েছে আজ বিশ পচিশ বছর ; দুটো মেয়ে ছিল, তারাও মারা গেল। সেও তের-চোদ্দ বছর আগে। এখন একাই আছি। —আচ্ছ, এই যে একা এখানে থাক, কারে সঙ্গে কথা বলে না, কোথাও যাও না, কিছু করও না—এ ভাল লাগে ? একঘেয়ে লাগে না ? জয়পাল অবাক হইয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিত—কেন খারাপ লাগবে হুজুর ? বেশ থাকি। কিছু খারাপ লাগে না ।