পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8e বিভূতি-রচনাবলী লোক এত নিষ্ঠুর কেন বনোয়ারীলাল ? বনোয়ারী পাটোয়ারী খুব দুঃখিত হইল। বনোয়ারী লোকটা ভাল, এদেশের তুলনায় সত্যিই তার হৃদয়ে দয়ামায়া আছে। কুস্তার ধামা ও আঁকশি সে তখনই পাইক দিয়া লবুটুলিয়াতে কুস্তার বাড়ী পাঠাইয়া দিল । সেই রাত্রি হইতে কুস্তা বোধ হয় লজ্জায় আর কাছারিতেও ভাত লইতে আসে নাই । ૨ শীত শেষ হইয়া বসন্ত পড়িয়াছে। আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্ব-দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি হইতে প্রায় চৌদ-পনের ক্রোশ দূরে ফাঙ্কন মাসে হোলির সময় একটা প্রসিদ্ধ গ্রাম্য মেলা বসে, এবার সেখানে যাইব বলিয়া ঠিক করিয়াছিলাম । বহু লোকের সমাগম অনেক দিন দেখি নাই, এদেশের মেলা কি রকম জানিবার একটা কৌতূহলও ছিল। কিন্তু কাছারির লোকে পুনঃ পুন: নিষেধ করিল, পথ দুর্গম ও পাহাড়-জঙ্গলে ভৰ্ত্তি, উপরন্তু গোট পথটার প্রায় সৰ্ব্বত্রই বাঘের ও বন্তমহিষের ভয়, মাঝে মাঝে বস্তি আছে বটে, কিন্তু সে বড় দূরে দূরে, বিপদে পড়িলে তাহারা বিশেষ কোন উপকারে আসিবে না, ইত্যাদি । জীবনে কখনও এতটুকু সাহসের কাজ করিবার অবকাশ পাই নাই, এই সময়ে এই সব জায়গায় যতদিন আছি যাহা করিয়া লইতে পারি, বাংলা দেশে ও কলিকাতায় ফিরিয়া গেলে কোথায় পাইব পাহাড় জঙ্গল, কোথায় পাইব বাঘ ও বন্ত-মহিষ ? ভবিষ্যতের দিনে আমার মুখে গল্পশ্রবণনিরত পৌত্র-পৌত্রীদের মুখ ও উৎসুক তরুণ দৃষ্টি কল্পনা করিয়া মুনেশ্বর মাহাতে, পাটোয়ারী ও নবীনবাবু মুহুরীর সকল আপত্তি উড়াইয়া দিয়া মেলার দিন খুব সকালে ঘোড় করিয়া রওনা হইলাম। আমাদের মহালের সীমানা ছাড়াইতেই ঘণ্টা-দুই লাগিয়া গেল, কারণ পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ সীমানাতেই আমাদের মহালের জঙ্গল বেশী, পথ নাই বলিলেও চলে, ঘোড়া ভিন্ন অন্ত কোন যান-বাহন সে পথে চলা অসম্ভব, যেখানে সেখানে ছোট-বড় শিলাখণ্ড ছড়ানো, শল-জঙ্গল, দীর্ঘ কাশ ও বন-ঝাউ-এর বন, সমস্ত পথটা উচু-নীচু, মাঝে মাঝে উচু বালিয়াড়ি রাঙা মাটির ডাঙা, ছোট পাহাড়, পাহাডের উপর ঘন কাট-গাছের জঙ্গল । আমি যদৃচ্ছাক্রমে কখনও দ্রুত, কখনও ধীরে অশ্বচালনা করিতেছি, ঘোড়াকে কদম চালে ঠিক চালানো সম্ভব হইতেছে না-খারাপ রাস্তা ওইতস্তত বিক্ষিপ্ত শিলাখণ্ডের দরুন কিছুদূর অন্তর অন্তর ঘোড়ার চাল ভাঙ্গিয়া যাইতেছে, কখনও গ্যালপ, কখনও হুলকি, কখনও বা পায়চারি করিবার মত মৃদ্ধ গতিতে শুধু হাটিয়া যাইতেছে। আমি কিন্তু কাছারি ছাড়িয়া পর্যন্তই অনিমো মগ্ন হুইয়া আছি, এখানে চাকুরি লইয়৷ আসার দিনটি হইতে এদেশের এই ধূ-ধূমুক্ত প্রাস্তর ও বনভূমি আমাকে ক্রমশ দেশ ভুলইয় দিতেছে, সভ্য জগতের শত প্রকারের আরামের উপকরণ ও অভ্যাসকে ভুলাইয়া দিতেছে, বন্ধু