পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२ বিভূতি-রচনাবলী সেখানে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে একদল লোক কাঠ পুড়াইয়া কয়লা করিতেছে—এই কয়লা তাহারা গ্রামে গ্রামে শীতকাল বেচিবে। এদেশের শীতে গরীব লোকে মালসায় কয়লার আগুন করিয়া শীত নিবারণ করে ; কাঠকয়লা চার সের পয়সায় বিক্ৰী হয়, তাও কিনিবার পয়সা অনেকের জোটে না, আর এত পরিশ্রম করিয়া কাঠকয়লা পুড়াইয়া পয়সায় চার সের দরে বেচিয়া কয়লাওয়ালাদের মজুরিই বা কি ভাবে পোষায়, তাও বুঝি না। এদেশে পয়সা জিনিসটা বাংলা দেশের মত সস্তা নয়, এখানে আসিয়া পৰ্য্যস্ত তা দেখিতেছি । শুকনো কাশ ও সাবাই ঘাসের ছোট্ট একটা ছাউনি কেঁদ ও আমলকীর বনে, সেখানে বড় একটা মাটির হাড়িতে মকাই সিদ্ধ করিয়া কাচা শালপাতায় সকলে একত্রে থাইতে বসিয়াছে, আমি যখন গেলাম। লবণ ছাড়া অন্য কোন উপকরণই নাই। নিকটে বড় বড় গৰ্ত্তের মধ্যে ডাল-পাল পুড়িতেছে, একটা ছোকরা সেখানে বসিয়া কাচা শালের লম্বা ডাল দিয়া আগুনে ডালপালাউণ্টাইয়া দিতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম—কি ও গৰ্ত্তের মধ্যে, কি পুড়ছে ? তাহারা খাওয়া ছাড়িয়া সকলে একযোগে দাড়াইয়া উঠিয়া ভীতনেত্রে আমার দিকে চাহিয়া থতমত খাইয়া বলিল—লকৃড় কয়লা হুজুর। আমার ঘোড়ায় চড়া মূৰ্ত্তি দেখিয়া লোকগুলা ভয় পাইয়াছে, বুঝিলাম আমাকে বনবিভাগের লোক ভাবিয়াছে। এসব অঞ্চলের বন গবর্নমেন্টের খাসমহলের অন্তৰ্ভুক্ত, বিনা অনুমতিতে বন কাটা কি কয়লা পোড়ানো বে-আইনী । তাহাদের আশ্বস্ত করিলাম। আমি বন বিভাগের কৰ্ম্মচারী নই, কোন ভয় নাই তাদের, যত ইচ্ছা কয়লা করুক। একটু জল পাওয়া যায় এখানে ? খাওয়া ফেলিয়া একজন ছুটিয়া গিয়া মাজা ঝকঝকে জামবাটিতে পরিষ্কার জল আনিয়া দিল । জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, কাছেই বনের মধ্যে ঝরণা আছে, তার জল । ঝরণা ?—আমার কৌতুহল হইল। ঝরণা কোথায় ? শুনি নাই তো এখানে ঝরণা আছে ! উহারা বলিল—ঝরণা নাই হুজুর, উলুই! পাথরের গর্তে একটু একটু করে জল জমে, এক ঘণ্টায় আধ সের জল হয়, খুব সাফ পানি, ঠাণ্ডও বহুৎ । জায়গাটা দেখিতে গেলাম। কি সুন্দর ঠাণ্ড বনবীথি ! পার্থীরা বোধ হয় এই নির্জন অরণ্যে শিলাতলে শরৎ বসন্তের দিনে, কি গভীর নিশীথ রাত্রে জলকেলি করিতে নামে। বনের খুব ঘন অংশে বড় বড় পিয়াল ও কেঁদের ডালপালা দিয়া ঘেরা একটা নাবাল জায়গা, তলাটা কালে পাথরের, একখানা খুব বড় প্রস্তর-বেদী যেন কালে ক্ষয় পাইয়া টেকির গড়ের মত হইয়া গিয়াছে। যেন খুব একটা বড় প্রাকৃতিক পাথরের খোরা । তার উপর সপুষ্প পিয়াল শাখা ঝুপসি হইয়া পড়িয়া ঘন ছায়ার স্বষ্টি করিয়াছে। পিয়াল ও শাল মঞ্জরীর সুগন্ধ বনের ছায়ার ভূরভূর করিতেছে। পাথরের খোলে বিন্দু বিন্দু জল জমিতেছে, এইমাত্র জল তুলির লইয়া গিয়াছে, এখনও অাধ ছটাক জলও জমে নাই ।