পাতা:বিভূতি রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড).djvu/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

এই সময় চুনি যদি তাহার বাবাকে বলিত—বাবা, তারের কোন দোষ নেই, আমারই সব দোষ, তাহা হইলে নারাণবাবুর মনের মত কাজ হইত ; নারাণবাৰু এই ভাবিয়া সপ্তস্বর্গ প্রাপ্ত হইতেন যে, চুনি তাহার অগাধ স্নেহের প্রতিদান দিল। কিন্তু যাহ। আশা করা যায়, তাহা হয় না। চুনি চুপ করিয়া রহিল। বাবাকে তাহারা দুই ভাই যমের মত ভয় করে। চুনির বাবা বলিলেন, মাস্টার, বোস । আমি আসচি, চ খেয়েচ ? এইবার চুনি মুখ তুলিয়া বলিল, ই বাবা, আমি এনে দিয়েছি। চুনির এ কথাটা নারাণবাবুর ভাল লাগিল না। চুনি এ কথা কেন বলিতেছে, নারাণণাৰু তাহা বুঝিতে পারিলেন। পাছে তাহার বাবা গিয়া আর এক কাপ চ মাস্টাবের জন্য পাঠাইয়া দেন, সে জন্য। কেন এক পেয়ালা চা বেশী দেওয়া হইবে মাস্টারকে । নারাণবাবু বাসায় ফিরিলেন, তখন রাত নয়ট। নিজের ছোট ঘরটার চাবি খুলিয়। রান্না চাপাইয়া দিলেন, তারপর যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণখানা লইয়া পড়িতে বসিলেন । এই সময়টাই বেশ লাগে সারাদিনের খাটুনির পরে। আজ স্কুলে এই ঘরে নারাণবাবু আছেন উনিশ বছর। বহুকাল হইল তাহার পত্নী স্বর্গগমন করিয়াছেন, নারাণবাৰু আর বিবাহ করেন নাই-পত্নীর স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য যত না হোক, গরিল-ফুল-মাস্টারজীবনে খরচ চালাইতে পারিবেন না বলিয়াই বেশী। উনিশ বৎসরের কত স্মৃতি এই ঘরের সঙ্গে জড়ানে। যখন প্রথম এই স্কুলে অনুকূলবাবু তাহাকে লইয়া আসেন, তখন এই ঘরে আর একজন বৃদ্ধ মাস্টার ভুবনবাবু থাকিতেন। ভুবনবাবুর বাড়ী ছিল মুর্শিদাবাদ–ভদ্রলোক বিবাহ করেন নাই, সংসারে এক বিধবা ভগ্নী ছাড়া তাহার আর কেহ ছিল না। একদিন বিছানায় লোকটি মরিয়া পড়িয়া ছিল এই ঘরেই। স্কুলের খরচে ভুবনবাবুর আস্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নারাণবাবু ভাবেন, তাহার অদৃষ্ট্রেও তাহাই নাচিতেছে। তাহাবুও কেহ নাই, স্বী নাই, পুত্র নাই, ভাই নাই, ভগ্নী নাই—এই ঘরটি আশ্রয় করিয়া সুজি বহুদিন কাটাইয়া দিলেন। এখন এমন হইয়া গিয়াছে, এই ঘর ও এই স্কুলের বাহিরে তাহার যেন আর কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই। জীবনের একমাত্র কৰ্ম্মক্ষেত্র এই স্কুল। স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসে রুটিন অনুযায়ী কোনদিন কী পড়াইবেন, নারাণবাৰু সকালে বসিয়া ঠিক করেন। কাল থার্ড ক্লাসে ললিত ছেলেটা ইংরেজী গ্রামারের 'দি'র ব্যবহার সম্বন্ধে অজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছে, নারাণবাবুর প্রাণে তাহার্তে এমন একটা ধাক্কা লাগিয়াছে, সে বেদন নিতান্ত বাস্তব। নারাণবাবু জানেন যে 'দি' ব্যবহার করিতে না পারিলে থার্ড ক্লাসের ছেলে হইয়া সে ইংরেজী ব্যাকরণ শিথিল কী ? কাল নারাণবাবু তখনই নোট-বইতে লিখিয়া লইয়াছেন, *ধার্ড ক্লাস, ললিতমোহন কর, ডেফিনিট আর্টিকল 'দি'।”—এইটুকু মাত্র দেখিলেই স্তুহার মনে পড়িবে। g তাহার পর আজ সেই ললিতকে ঝাড়া আধ ঘণ্টা ধরিয়া জিনিসটা শিখাইয়া দিলেন,