নীলাম্বর অতিকষ্টে শুষ্কহাসি ওষ্ঠপ্রান্তে টানিয়া আনিয়া বলিল, সব বুঝি বিরাজ, কিন্তু শালগ্রামে সুমুখে রেখে শপথ করেচি ষে? তার কি হবে?
বিরাজ তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, কিচ্ছু হবে না। শালগ্রাম যদি সত্যিকারের দেবতা হন, তিনি আমার কষ্ট বুঝবেন। আর আমি ত তোমারই অর্ধেক, যদি কিছু এতে পাপ হয়, আমি আমার নিজের মাথায় নিয়ে জন্ম জন্ম নরকে ডুবে থাকব; তোমার কিছু ভয় নেই—তুমি আর ঋণ ক’রো না।
নীলার কাতরদটিতে একটিবার মাত্র স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া পরক্ষণেই নিরুপায়ের মত মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। ধর্মপ্রাণ স্বামীর অন্তরের নিদারুণ দুঃখের লেশমাত্রও তাহার অগোচর ছিল না। কিন্তু সে আর সহিতে পারিতেছিল না। যথার্থই স্বামী তাহার সর্বস্ব ছিল। সেই স্বামীর অহর্নিশি চিন্তাক্লিষ্ট শুষ্ক অবসন্ন মুখের পানে চাহিয়া তাহার বুক ফাটিতেছিল। এতক্ষণ কোনমতে সে কান্না চাপিয়া কথা কহিতেছিল, আর পারিল না। সবেগে স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
নীলাম্বর তাহার দক্ষিণ হস্ত বিরাজের মাথার উপরে রাখিয়া নির্বাক নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ কান্নার পরে তাহার দুঃখের অসহ তীব্রতা মন্দীভূত হইয়া আসিলে সে তেমনই মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ছেলেবেলা থেকে যতদূর আমার মনে পড়ে, কোন দিন তোমার মুখ ভার করতে দেখিনি; এখন তোমার পানে চাইলেই আমার বুকের মধ্যে রাবণের চিতা জ্বলতে থাকে—তুমি নিজের পানে না চাও, আমার দিকে একবার চেয়ে দেখ! সত্যিই কি শেষকালে আমাকে পথের ভিখারিণী করবে? সে কি তুমিই সইতে পারবে?
নীলাম্বর তথাপি উত্তর দিতে পারিল না, অন্যমনস্কের মত তাহার চুলগুলি লইয়া ধীরে ধীরে মাথা নাড়িতে লাগিল। এমনি সময়ে দ্বারের বাহিরে পুরানো ঝি সুন্দুরী ডাকিয়া বলিল, বৌমা, উনুন জ্বেলে দেব কি?
বিরাজ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া আঁচলে চোখ মুছিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল।
সুন্দরী পুনরায় কহিল, উনুন জ্বেলে দেব?
বিরাজ অস্পষ্টস্বরে বলিল, দে, তোদের জন্যে রাঁধতে হবে, আমি আর কিছু খাব না।
ঝি বড় গলায় নিলাম্বরকে শুনাইয়া বলিল, তুমি কি মা, তবে রাত্তিরে খাদ্য একেবারে ছেড়ে দিলে? না খেয়ে যে একেবারে আধখানি হয়ে গেলে।
বিরাজ তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া রান্নাঘরের দিকে লইয়া গেল।
জ্বলন্ত উনুনের আলো বিরাজের মুখের উপর পড়িয়াছিল। অদূরে বসিয়া সুন্দরী