পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৮
বিরাজবৌ

 নীলাম্বর ছোটভাইয়ের এ কথাটাও সহ্য করিয়া বলিল, যা সত্যি নয়, তাই আমি মনে করি! আচ্ছা, তাই ভাল, এ নিয়ে তোর সঙ্গে আমি ঝগড়া করতে চাইনে, কিন্তু আমার চিঠির জবাব দেয় না এই জন্যে তোকে ডাকিনি—যা বলচি, পারিস কি না, তাই বল।

 পীতাম্বর মাথা নাড়িয়া বলিল, না বিয়ের আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?

 করলে কি হ’ত?

 পীতাম্বর বলিল, ভাল পরামর্শই দিতুম।

 নীলাম্বরের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিতে লাগিল, তাহার ওষ্ঠাধর কাঁপিতে লাগিল, তবুও সে নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া বলিল, তা হলে পারবি নে?

 পীতাম্বর বলিল, না। আর, পুঁটির শ্বশুরও যা, নিজের শ্বশুরও তাই—এঁরা গুরুজন। তিনি যখন পাঠাতে ইচ্ছা করেন না, তখন তার বিরুদ্ধে আমি কথা কইতে পারিনে—ও স্বভাব আমার নয়।

 তাহার কথা শুনিয়া নীলাম্বরের একবার ইচ্ছা হইল, ছুটিয়া গিয়া লাথি মারিয়া উহার ঐ মুখ গুঁড়া করিয়া ফেলে, কিন্তু নিজেকে সামলাইয়া ফেলিয়া দাঁড়াইয়া, উঠিয়া বলিল, যা বেরো—যা আমার সামনে থেকে।

 পীতাম্বরও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল, বলিল, খামকা রাগ কর কেন দাদা? না গেলে তুমি কি আমাকে জোর করে তাড়াতে পার?

 নীলাম্বর দরজার দিকে হাত প্রসারিত করিয়া বলিল, বুড়ো বয়সে মার খেয়ে যদি না মরতে চাস, সরে যা আমার সুমুখ থেকে!

 তথাপি পীতাম্বর কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু, নীলাম্বর বাধা দিয়া বলিল, বাস্! একটি কথাও না-যাও।

 গোঁয়ার নীলাম্বরের গায়ের জোর প্রসিদ্ধ ছিল।

 পীতাম্বর আর কথা কহিতে সাহস করিল না, আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গেল।

 বিরাজ গোলযোগ শুনিয়া বাহিরে আসিয়া স্বামীর হাত ধরিয়া ঘরের মধ্যে টনিয়া লইয়া গিয়া বলিল, ছি, সমস্ত জেনেশুনে কি ভাইয়ের সঙ্গে কেলেঙ্কারী করতে আছে?

 নীলাম্বর উদ্ধতভাবে জবাব দিল, জানি বলে কি ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকব?

 আমার সব সহ্য হয় বিরাজ, ভণ্ডামি সহ্য হয় না।

 বিরাজ বলিল, কিন্তু তুমি ত একা নও, আজ হাত ধরে বার করে দিলে কাল কোথায় দাঁড়াবে, সে কথা একবার ভাব কি?

 নীলাম্বর বলিল, না। যিনি ভাববার তিনি ভাবেন, আমি ভেবে মিথ্যে দুঃখ পাইনে।