পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৬
বিরাজবৌ

 নীলাম্বর ব্যস্ত হইয়া বলিল, খুলে দে না বিরাজ!

 এবার বিরাজ কাঁদ-কাঁদ হইয়া মৃদুস্বরে বলিল, তুমি মারবে না বল?

 মারব!

 কথাটা তীক্ষ্ণধার ছুরির মত নীলাম্বরের হৃৎপিণ্ডে গিয়া প্রবেশ করিল; বেদনায়, লজ্জায়, অভিমানে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল, সে সংজ্ঞাহীনের মত একটা চৌকাঠ আশ্রয় করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বিরাজ তাহা দেখিল না; সে না জানিয়া ছুরির উপর ছুরি মারিয়া কাঁদিয়া বলিল, আর আমি এমন কথা ক’ব না—বল, মারবে না?

 নীলাম্বর অস্ফুটম্বরে, কোনমতে একটা ‘না’ বলিতে পারিল মাত্র। সভয়ে ধীরে ধীরে অর্গল মুক্ত করিবামাত্রই নীলাম্বর টলিতে চলিতে ভিতরে ঢুকিয়া চোখ বুজিয়া শয্যার উপর শুইয়া পড়িল। তাহার নিমীলিত চোখের দুই কোণ বাহিয়া হুহু-করিয়া জল পড়িতে লাগিল। স্বামীর এমন মুখ ত বিরাজ কোন দিন দেখে নাই! সমস্তই বুঝিল। শিয়রের কাছে উঠিয়া আসিয়া পরম স্নেহে স্বামীর মাথা নিজের ক্রোড়ের উপর তুলিয়া আঁচল দিয়া চোখ মুছাইয়া দিতে লাগিল। ক্রমে সন্ধ্যার আঁধার ঘরের মধ্যে গাঢ় হইয়া আসিতে লাগিল, তথাপি উভয়ের কেহই মুখ খুলিল না। তাহাদের কথা বোধ করি শুধু অন্তর্যামীই শুনিলেন।


আট

 তবুও নীলাম্বর ভাবিতেছিল—এ কথা বিরাজ মুখে আনিল কি করিয়া! সে তাহাকে মারধর করিতেও পারে, তাহার সম্বন্ধে এত বড় হীন ধারণা তাহার জন্মিল কেন? একে ত সংসারে দুঃখ-কষ্টের অবধি নাই, তাহার উপর প্রতিদিন এ কি হইতে লাগিল? দু’দিন যায় না, বিবাদ বাধে, কথায় কথায় মনোমালিন্য, চোখে চোখে কলহ পদে পদে মতভেদ হয়। সর্বোপরি তাহার এমন বিরাজ দিন দিন এমন হইয়া যাইতে লাগিল—অথচ কোন দিকে চাহিয়া সে এই দুঃখের সাগরের কিনারা দেখিল না। নীলাম্বরের ভগবানের চরণে অচলা ভক্তি ছিল, অদৃষ্টের লেখার অসীম বিশ্বাস ছিল, সে সেই কথাই ভাবিতে লাগিল, কাহাকেও মনে মনে দোষ দিল না, কাহারও নিন্দা করিল না—চণ্ডীমণ্ডপের দেয়ালে টাঙ্গানো রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির সুমুখে দাঁড়াইয়া ক্রমাগত কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, ভগবান, যদি এত দুঃখেই ফেলবে মনে ছিল, তবে এতবড় নিরুপায় করে আমাকে গড়লে কেন? সে যে কত নিরুপায়, সে কথা তাহার অপেক্ষা বেশী আর কেহই জানে না। লেখাপড়া শিখে নাই, কোন রকমের কাজকর্ম জানিত না, জানিত শুধু দুঃখীর সেবা করিতে, শিখিয়াছিল শুধু ভগবানের নাম করিতে। তাহাতে পরের দুঃখ ঘুচিত বটে,