পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৭৬
বিরাজবৌ

বৌদির এ কলঙ্ক শুনলে বল ত মা, তার বুকের ভিতর কি করতে থাকবে। আর ত সে মুখ তুলে চাইতেও পারবে না।

 সুন্দরী আত্মগ্লানি সহ্য করিতে না পারিয়া মাস-দুই পূর্বে নীলাম্বরের কাছে কবুল করিয়া ফেলিয়াছিল, সে রাত্রে বিরাজ মরে নাই, জমিদার রাজেন্দ্রর সহিত গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে। সে নীলাম্বরের মনোকষ্ট আর দেখিতে পারিতেছিল না। মনে করিয়াছিল, এ কথার সে ক্রোধের বশে হয়ত দুঃখ ভুলিতে পারিবে! ঘরে আসিয়া নীলাম্বর এ কথা বলিয়াছিল।

 সেই কথা মনে করিয়া ছোটবৌ খাণিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদুস্বরে বলিল, ঠাকুরঝিকে জানিয়ে কাজ নেই!

 কি করে লুকাবো মা? যখন জিজ্ঞেস করবে, বৌদির কি হয়েছিল, তখন কি জবাব দেবে?

 ছোটবৌ বলিল, যে কথা সকলে জানে, দিদি নদীতে প্রাণ দিয়েচেন—তাই।

 নীলাম্বর মাথা নাড়িয়া কহিল, তা হয় না মা? শুনেচি, পাপ গোপন করলেই বাড়ে; আমরা তার আপনার লোক, আমরা তার পাপের ভরা আর বাড়িয়ে দেব না। বলিয়া সে একটুখানি হাসিল। সেটুকু হাসিতে কত ব্যথা, কত ক্ষমা, তাহা ছোটবৌ বুঝিল। খানিক পরে ছোটবৌ অতিশয় সঙ্কুচিতভাবে মৃদুস্বরে বলিল, এ-সব কথা হয়ত সত্যি নয়, বাবা!

 কোন্ সব কথা মা? তোমার দিদির কথা?

 ছোটবৌ নতমুখে মৌন হইয়া রহিল।

 নীলাম্বর বলিল, সত্যি বৈ কি মা—সব সত্যি। জান ত মা, রেগে গেলে সে পাগলীর জ্ঞান থাকত না। যখন এতটুকুটি ছিল, তখনও তাই। তাতে যে অত্যাচার, যে অপমান করেছিলাম, সে সহ্য করতে বোধ করি স্বয়ং নারায়ণও পারতেন না—সে ত মানুষ। নীলাম্বর হাত দিয়া এক ফোঁটা অশ্রু মুছিয়া বলিল, মনে হ’লে বুক ফেটে যায় মা, হতভাগী তিন দিন খায় নি, জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে আমার জন্যে দুটি চাল ভিক্ষে করতে গিয়েছিল, সেই অপরাধে আমি—আর যেন বলিতে পারিল না, কোঁচার খুঁট মুখে গুঁজিয়া দিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন সবলে নিরোধ করিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল।

 ছোটবৌ নিজেও তেমনই করিয়া কাঁদিতেছিল, সেও কথা কহিল না। বহুক্ষণ কাটিল।

 বহুক্ষণে নীলাম্বর কতটা প্রকৃতিস্থ হইয়া চোখমুখ মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, অনেক কথাই তুমি জান, তবু শোন মা। কি ক’রে জানিনে, সেই রাতেই সে অজ্ঞান উন্মত্ত হয়ে সুন্দরীর বাড়িতে গিয়ে উঠে, তারপরে—উঃ—টাকার লোভে সুন্দরী পাগলীকে আমার সেই রাতেই রাজেনবাবুর বজরায় তুলে দিয়ে আসে—