পাতা:বিশ্বকোষ ঊনবিংশ খণ্ড.djvu/৩৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
[৩৮৫]
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

নাই। তৎপূর্ব্বে তিনি Indian field নামক পত্রিকায় “রাজমোহনের স্ত্রী” (Rajmohan wife) নামে একখানি উপন্যাস লিখিতে আরম্ভ করেন, কিন্তু ঐ পত্রিকাখানি বন্ধ হইয়া যাওয়ায় তাঁহার ইংরাজী উপন্যাসখানিও অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়।

 পূর্ব্বেই পরিচয় দিয়াছি যে, ইংরাজীভাষায় বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি হইয়াছিল। ষ্টেট্‌স্‌ম্যান্ পত্রিকায় জেনেরল এসেম্ব্লির ভূতপূর্ব্ব প্রিন্সিপাল হেষ্টি সাহেবের সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের যে মসিযুদ্ধ চলিয়াছিল, তাহাতে তাঁহার ইংরাজী লেখা পড়িয়া সকলেই বিমুগ্ধ হইয়াছিলেন। এমন কি, তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী হেষ্টি সাহেবও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছিলেন, “এতদিন পরে বাঙ্গালায় একজন উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী পাইয়াছি।”

 সরকারী চাকুরী হইতে অবসর গ্রহণের কয়েক বৎসর পূর্ব্বে বঙ্কিমচন্দ্র বেঙ্গল গবর্মেণ্টের সহকারী সেক্রেটারীর পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু নানা কারণে তাঁহাকে সে পদ পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল।


বঙ্কিমবাবুর প্রতিমূর্ত্তি।

 দুর্গেশনন্দিনী প্রচারের সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের খ্যাতি সর্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়িল। তৎপরে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে কপালকুণ্ডলা ও ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে মৃণালিনী বাহির হইল। ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে বঙ্গদর্শন বাহির হইল। বঙ্গদর্শন প্রকাশের সহিত যেন বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর উপস্থিত হইল! বঙ্গীয় লেখকগণের রুচিও পরিবর্ত্তিত হইল। শিক্ষিত বঙ্গবাসীর নিকট বঙ্গদর্শনের যেরূপ আদর হইয়াছিল, এরূপ কোন সাময়িক পত্রের সমাদর দৃষ্টিগোচর হয় না। বঙ্গদর্শনের সম্পাদকরূপে বঙ্কিমচন্দ্র আজকালকার শ্রেষ্ঠ অনেক লেখককেই লিখিবার রীতি শিখাইয়া ছিলেন এবং নিজেও বঙ্গদর্শনে বহু প্রবন্ধ ও উপন্যাস লিখিয়া
সাহিত্যজগতে একাধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। যাঁহারা বঙ্গভাষাকে স্বীয় মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিতে লজ্জাবোধ করিতেন, বটতলার পুঁথি দেখিয়া যাঁহারা নাসাকুঞ্চন করিতেন, ইংরাজীভাষায় লিখিত পুস্তকই যাঁহাদের একমাত্র বেদস্বরূপ ছিল, বিদেশীর অনুকরণকেই যাঁহারা জীবনের একমাত্র কৃতকৃতার্থতার কারণ বলিয়া গণ্য করিতেন—সেই পরম উদ্ধত প্রাজ্ঞমানী নব্যবঙ্গকে বঙ্কিমবাবুই বঙ্গভারতীর মন্দিরে উপস্থিত করিয়া তচ্চরণে অর্ঘ্যপ্রদান করিতে বাধ্য করেন, তদবধি ইংরাজীশিক্ষিত যুবকমণ্ডলীই বঙ্গভাষার সেবকগণের নেতা হইয়া দাঁড়াইয়াছেন,—বঙ্কিমবাবুর এই কার্য্য মাতৃভাষা-চর্চাকল্পে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সার্থকতা বলিয়া গণ্য হইতে পারে, এই জন্যই তিনি “বঙ্গভাষার সম্রাট্” পদবাচ্য। তিনি বঙ্গদর্শনে নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি প্রকাশ করেন:—

 ১২৭৯ সালে বিষবৃক্ষ ও ইন্দিরা; ১২৮০ সালে চন্দ্রশেখর ও যুগলাঙ্গুরীয়; ১২৮১ সালে রজনী; ১২৮০ǀ৮১ ও ৮২ সালে কমলাকান্তের দপ্তর, ১২৮৪ সালে কৃষ্ণকান্তের উইল, ১২৮৬ সালে রাজসিংহ, ১২৮৭ ও ৮৯ সালে আনন্দমঠ, ১২৮৭ সালে মুচীরামগুড়ের জীবনচরিত, ১২৮৮ সালে দেবী চৌধুরাণী। দেবী চৌধুরাণী বঙ্গদর্শনে কিয়দংশ বাহির হইয়া শেষে পুস্তকাকারে সমগ্র পুস্তক প্রকাশিত হয়। ১২৮৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনের সম্পাদকতা ছাড়িয়া দিলে তাঁহার জ্যেষ্ঠ সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদক হন। সঞ্জীবচন্দ্রের মৃত্যুর পর বঙ্গদর্শন উঠিয়া যায়।

 কএক বর্ষ পরে সাধারণী-সম্পাদক শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয়ের চেষ্টায় নবজীবন প্রকাশিত হয়। নবজীবনের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র যেন নবজীবন লাভ করিলেন। আনন্দমঠের শেষে এবং দেবী চৌধুরাণীতে তিনি যে জ্ঞান ও কর্ম্মযোগের সূত্রপাত করেন, সীতারামে তাহার পরিণতি।

 বঙ্গের শেষ গৌরবরবি সীতারামের প্রকৃত আলেখ্য তাঁহার তুলিকায় একটু ভিন্নরূপে চিত্রিত হইলেও, তাঁহার জীবনে যে সন্ন্যাসিরূপী মহাপুরুষের প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল, সীতারামে বঙ্কিমচন্দ্র সেই চিত্রই দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। ঐ সময় বঙ্কিমচন্দ্রের জামাতা রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় “প্রচার” নামক এক মাসিক পত্র প্রচার করেন। এই মাসিক পত্র খানি যে বঙ্কিম বাবুর সম্পূর্ণ পরামর্শানুসারে প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রচারে তিনি কৃষ্ণচরিত্র ও গীতামর্ম্ম এবং নবজীবনে ধর্ম্মতত্ত্ব প্রকাশ করিয়া তাঁহার নবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য সাধারণের চিত্তগোচর করিয়াছিলেন।

 ডেপুটীকার্য্যে ও বৃটীশগবর্মেণ্টের নিকট তাঁহার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। যথাকালে তিনি পেন্‌সন্ গ্রহণ করিয়া অবসর